You are currently viewing সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্রি স্টাইলে ভিডিও/ছবি ছাড়া কি জায়েয হয়ে গেল?

সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্রি স্টাইলে ভিডিও/ছবি ছাড়া কি জায়েয হয়ে গেল?

লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :

সম্প্রতি ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে উলামা ও তালাবার ছবি ও ভিডিও-র উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আমি প্রাণীর ছবি ও প্রাণীর ছবিসম্বলিত ভিডিও প্রসঙ্গে উলামা ও তালাবা সমীপে কিছু কথা নিবেদন করতে চাই। প্রথমে ভিডিও প্রসঙ্গে তারপর স্থির ছবি প্রসঙ্গে। তার আগে এ যাবত উলামায়ে উম্মত যেসব হাদীছের ভিত্তিতে ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্যকে হারাম বলে আসছেন তার মধ্য থেকে দু’টো মারফূ’ হাদীছ উল্লেখ করে নিচ্ছি।

(١) إنَّ أصْحَابَ هذِه الصُّوَرِ يَومَ القِيَامَةِ يُعَذَّبُونَ، فيُقَالُ لهمْ: أحْيُوا ما خَلَقْتُمْ. (رواه البخاري في صحيحه برقم ٢١٠٥)

অর্থাৎ, যারা ছবি বা মূর্তি তৈরি করে, কেয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে এবং (শাসিয়ে) বলা হবে, (খুব তো সৃষ্টি করতে পারো ভাব দেখিয়েছ, তা এখন) যা সৃষ্টি করছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে দেখাওতো! (বোখারী: হাদীছ নং ২১০৫)

(٢) إن أشد الناس عذابا عند الله يوم القيامة المصورون. (رواه البخاري في صحيحه برقم ٥٩٥٠ ومسلم في صحيحه برقم ٥٦٥٩)

অর্থাৎ, অবশ্যই কেয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট লোকদের মাঝে সবচেয়ে বেশি কঠিন শাস্তি হবে তাদের যারা চিত্র (এমনিভাবে মূর্তি/ভাস্কর্য) বানায়। (বোখারী: হাদীছ নং ৫৯৫০ ও মুসলিম: হাদীছ নং ৫৬৫৯ )
এবার ভিডিও এবং ছবি প্রসঙ্গে আলোচনায় আসছি।

ভিডিও প্রসঙ্গ
ভিডিও ভিন্ন সময়ে করে পরে মিডিয়ায় আপলোড করা হোক বা সরাসরি লাইভে ছাড়া হোক জায়েয হলে উভয়টার একই হুকুম হওয়ার কথা। আবার না-জায়েয হলেও উভয়টার একই হুকুম হওয়ার কথা। উলামায়ে কেরামের কেউ কেউ এখনও যে প্রকারের ভিডিওই হোক না কেন তা না-জায়েয তথা হারাম হওয়ার মতেই অটল রয়েছেন। পক্ষান্তরে অনেকে জায়েয হওয়ার পক্ষে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ তো স্পষ্টতই জায়েযের ফতোয়া দিয়ে দিয়েছেন, আবার অনেকে মৌখিকভাবে ফতোয়া না দিলেও নিজেদের উদ্যোগে ভিডিও তৈরি করে তা আপলোড করা কিংবা লাইভ করার মাধ্যমে বা এরূপ করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে কার্যত সব রকম ভিডিও জায়েয হওয়ার মতেই চলে গিয়েছেন।
যারা এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও তৈরি করে তা আপলোড করা কিংবা লাইভ করাকে জায়েয বলে ফতোয়া দিচ্ছেন তারা মূলত তিনটা যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। নিম্নে যুক্তিত্রয় কিঞ্চিত পর্যালোচনাসহ পেশ করা হল।

১. শরীয়তে যে ছবিকে হারাম করা হয়েছে তা হচ্ছে স্থির ছবি। আর ভিডিও বা লাইভে স্থির ছবি থাকে না। অর্থাৎ তাতে ইস্তিকরার (استقرار) তথা স্থিতি থাকে না। আর যে ছবিতে ইস্তিকরার তথা স্থিতি না থাকে তা আয়না বা পানিতে প্রতিবিম্বিত ছবির মত হওয়ায় জায়েয। অতএব ভিডিও বা লাইভের ছবি স্থির ছবি না হওয়ার কারণে জায়েয, তা নিষিদ্ধ ছবির আওতাভুক্ত নয়।
কিন্তু এখানে দু’টো বিষয় বিবেচনার রয়েছে। (এক) ভিডিও-র ছবিকে আয়না বা পানিতে প্রতিবিম্বিত ছবির উপর কেয়াস করা যায় কি না। যুক্তি বলে, যায় না। কারণ আয়না বা পানিতে প্রতিবিম্বিত ছবি আর ক্যামেরার ছবির মধ্যে বহুভাবে পার্থক্য রয়েছে। যেমন: (১) আয়না বা পানিতে প্রতিবিম্বিত ছবির কোন উপাদান নেই, সেটা নিছক একটা ছায়া। পক্ষান্তরে ভিজিটাল ছবির উপাদান থাকে। সেটা হল পিক্সেল। (পিক্সেল সম্বন্ধে পরে বিবরণ আসছে।) সুতরাং উপাদানযুক্ত একটা জিনিসকে নিছক একটা ছায়ার উপর কেয়াস করা কেয়াস মাআল ফারেক্ব। (২) ছায়ার উপর কোন হুকুম আসে না। পক্ষান্তরে ছবির উপর হুকুম আসে। যেমন কোন মুরব্বির ছায়ার উপর পা রাখলে সেটাকে ঐ মুরব্বির অবমাননা গণ্য করা হবে না, অথচ সেই মুরব্বির ছবির উপর পা রাখলে সেটাকে অবমাননা গণ্য করা হবে। এ হিসেবেও যার উপর হুকুম আসে সেই ছবিকে যার উপর হুকুম আসে না সেই ছায়ার উপর কেয়াস করা কেয়াস মাআল ফারেক্ব। বস্তুত ছায়া ও ছবি দুটো ভিন্ন ধরনের জিনিস। (৩) ক্যামেরার ছবি এখতিয়ারী, পক্ষান্তরে পানি ও আয়নায় প্রতিবিম্ব পড়া গায়র এখতিয়ারী। অতএব এখতিয়ারী জিনিসের হুকুম গায়র এখতিয়ারী জিনিসের মত হতে পারে না। (দুই) ভিডিও-র ছবিতে ইস্তিকরার তথা স্থিতি না থাকার ভিত্তিতে ভিডিও জায়েয হওয়ার যুক্তি দাঁড় করানো গেলেও সে যুক্তি অকাট্য নয় বরং এখানে ভিডিও না-জায়েয হওয়ার যুক্তিরও অবকাশ থেকে যায়। তাহল ছবিতে স্থিতি থাকুক বা না থাকুক যে খারাবিগুলোর কারণে (যেসব ইল্লতের কারণে) ছবি নিষিদ্ধ হয়েছে সে খারাবিগুলো উভয় রকমের ছবিতেই বিদ্যমান। অতএব উভয় রকমের ছবিই নিষিদ্ধ প্রতিপন্ন হওয়া চাই।
উলামায়ে কেরাম ছবি (তদ্রূপ মূর্তি/ভাস্কর্য) হারাম হওয়ার পেছনে যেসব খারাবী (তথা ইল্লত)-এর কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে বিশেষ ৩টা খারাবি (যেগুলো ইবনুল আরাবি তার ‘আহকামুল কুরআন’য়ে উল্লেখ করেছেন।) একটু মুদাল্লাল আকারে আমি পেশ করছি।

(১) প্রথম খারাবী হল- এর দ্বারা আল্লাহর খালক তথা “সৃষ্টিকরণ” কর্মের সঙ্গে সাদৃশ্য (বলা যায় টেক্কা) হয়ে যায়। এজন্যই সহীহ হাদীছে এসেছে যারা ছবি বা মূর্তি তৈরি করে, কেয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে এবং (শাসিয়ে) বলা হবে, (খুব তো সৃষ্টি করতে পারো ভাব দেখিয়েছ, তা এখন) যা সৃষ্টি করছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে দেখাওতো! হাদীছটি এই-

إنَّ أصْحَابَ هذِه الصُّوَرِ يَومَ القِيَامَةِ يُعَذَّبُونَ، فيُقَالُ لهمْ: أحْيُوا ما خَلَقْتُمْ. (رواه البخاري في صحيحه برقم ٢١٠٥)

হাদীছটির তর্জমা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, হাতে ছবি তৈরি করলে যদি নিষিদ্ধ হতে পারে তাহলে ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তৈরি করলেও তা নিষিদ্ধ না হওয়ার কোন কারণ নেই, যেমন মূর্তি হাতে বানালে যেমন নিষিদ্ধ মেশিনের সাহায্যে বানালেও নিষিদ্ধ। বস্তুত ক্যামেরার ছবি হাতের বদলে মেশিনের তৈরি। তাই এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, ভিডিও বা ডিজিটাল ছবিতে ছবি আঁকা হয় না বরং একটা ছাপ নেয়া হয় মাত্র।

(২) দ্বিতীয় খারাবি হল- কাফেররা মূর্তি ও ছবির পূজা করে থাকে, অতএব কেউ পূজার উদ্দেশ্যে ছবি না রাখলেও এটা পূজার দিকে গড়াতে পারে বিধায় শুরু থেকেই তার পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তদুপরি এটা যারা পূজার উদ্দেশ্যে রাখে তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় তা নিষিদ্ধ তথা হারাম। শরীয়তে তাশাব্বুহ বিল কুফফার তথা কাফেরদের সঙ্গে (আমাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ এমন কোন ধর্মীয় বিষয়ে) সাদৃশ্য অবলম্বন করা হারাম। এজন্যই সূর্য পূজারীরা সূর্য উদয় ও অস্ত যাওয়ার সময় সূর্যের পূজা করে থাকে বিধায় এ দুই সময়ে নামায পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বস্তুত তাশাব্বুহ বিল কুফফার হারাম হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা’ রয়েছে। যেমন ওয়ালীদ ইবনে রাশেদ আস-সায়ীদান রচিত تشنيف الأسماع ببعض مسائل إلاجماع গ্রন্থে বলা হয়েছে,

أجمعوا على المنع من التشبه بالكفار فيما هو من عاداتهم وعبادتهم.

(৩) তৃতীয় খারাবি হল- ছবি দ্বারা ছবি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে আত্মিক সম্পর্ক কায়েম হয়, আর এটা ধীরে ধীরে তার প্রতি সম্মান ও তার পূজার দিকে গড়ায়। আর ফিকহের উসূল রয়েছে-

ما أدى إلى الحرام فهو حرام. (قواعد الأحكام في مصالح الأنام لعز الدين عبد العزيز بن عبد السلام)

অর্থাৎ, যা হারামের দিকে গড়ায় তা হারাম। অতএব শুধু ছবি/মূর্তির পূজাই নয় ছবি বা মূর্তি/ভাস্কর্য তৈরি করাও হারাম।
ছবি হারাম হওয়ার এসব কারণের ভিত্তিতে ছবি স্থির হোক বা না হোক উভয় রকম ছবিই একই হুকুমভুক্ত তথা নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। অন্তত এতটুকু তো বলতেই হবে যে, এক যুক্তিতে না-জায়েয মনে না হলেও আর এক যুক্তিতে না-জায়েয মনে হয়। অতএব জায়েয হওয়া এবং না-জায়েয হওয়া উভয়টার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ফিকহ ও ফতোয়ার উসূল (মূলনীতি) অনুযায়ী কোন বিষয়ে জায়েয হওয়া ও না-জায়েয হওয়া উভয় দিকের সম্ভাবনা থাকলে সেখানে না-জায়েয হওয়ার দিকটাকে প্রাধান্য দিতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে তাকওয়া হল না-জায়েয হওয়ার দিকের উপর আমল করা। সেমতে এরূপ ভিডিও থেকে বিরত থাকাই তাকওয়া। আর ফতোয়াও হওয়া নিয়ম তাকওয়ার দিক অনুসারে। উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে উপরোক্ত মূলনীতিটির পক্ষে কয়েকটি বরাত পেশ করা হল-

إذا اجتمع الحلال والحرام غلب الحرام. (الوجيز في شرح القواعد الفقهية لعبد الكريم زيدان : الصفحة ١٨٥، القواعد الفقهية بين الأصالة والتوجيه لمحمد بكر اسماعيل: الصفحة ١٢٢ و الأشباه والنظائر لابن نجيم : الصفحة ٣٠١)
ما اجتمع محرم ومبيح إلا غلب المحرم. (قواعد الفقه للسيد محمد عميم الإحسان المجددي : الصفحة ١١٤ برقم ٢٨٥)

যাহোক যারা টেলিভিশনসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও তৈরি করে তা আপলোড করা কিংবা লাইভ করাকে জায়েয বলে ফতোয়া দেন এটা ছিল তাদের একটা যুক্তি এবং সে সম্বন্ধে কিছু পর্যালোচনা।

২. কেউ কেউ মিডিয়াতে ভিডিও ছাড়া জায়েয হওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন এই বলে যে, বাতিল যে সূরতে আসে সেই সূরতেই তার মোকাবেলা করতে হয়। আর বর্তমানে বাতিল মিডিয়া জগতের মাধ্যমে ফিতনা ছড়াচ্ছে। তাই মিডিয়া জগতে এসে তার মোকাবেলা করতে হবে। এই যুক্তির ব্যাপারে কথা হল- মিডিয়া জগতের ফিতনা মিডিয়া জগতে এসেই মোকাবেলা করতে হবে- এই যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু এখানে ভাববার বিষয় হল- বাতিলরা মিডিয়া জগতে যে ফিতনা ছড়াচ্ছে সেই ফিতনা ছড়াচ্ছে কি বক্তব্যের মাধ্যমে না ভিডিওর মাধ্যমে। অর্থাৎ ফিতনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা কি বক্তব্যের না ভিডিও-র ছবির। স্পষ্ট কথা যে, ফিতনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা বক্তব্যের, ভিডিও-র ছবির নয়। তাহলে তার মোকাবেলার জন্য মিডিয়া জগতে অডিও ছাড়লেই বা কোন লেখা ছাড়লেই যথেষ্ট, ভিডিও-র আবশ্যকতা কীভাবে প্রমাণিত হল? তদুপরি “বাতিল যে সূরতে আসে সে সূরতে তার মোকাবেলা করা নিয়ম”-এর অর্থ আদৌ এ নয় যে, বাতিল কোন না-জায়েয তরিকায় এলেও আমাদেরকে সেই না-জায়েয তরিকায়ই আসতে হবে।
এই আলোচনা দ্বারা তাদের যুক্তিরও খণ্ডন হয়ে গেল যারা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ছেড়ে দিলে পৃথিবীর বহু মানুষ দেখবে, তাদের দ্বীনী ফায়দা হবে। এখানেও ঐ একই কথা- ফায়দা হলে সেটা বক্তব্য দ্বারা হবে, ভিডিও-র ছবি দেখে নয়। অতএব অডিও-র দরকার আছে বলা যাবে ভিডিও-র নয়। অডিও ছাড়া শুধু লেখা দ্বারাও দ্বীনী ফায়দা পৌঁছানোর কাজ সম্পন্ন হতে পারে।

৩. তাদের আরেকটা যুক্তি হল- দ্বীনী দাওয়াত, হকের প্রচার ও বাতিলের খণ্ডনে অডিও-র চেয়ে ভিডিও বেশি আকর্ষণীয় ও আবেদনময়ী হয়ে থাকে। এটাকে জরূরত গণ্য করা হবে। আর ফিকহের সর্বসম্মত একটা মূলনীতি হল-

الضرورات تبيح المحظورات. (الأشباه والنظائر ورد المحتار والقواعد والضوابط الفقهية المتضمنة للتيسير)

অর্থাৎ, জরূরত নিষিদ্ধ বিষয়াদিকে বৈধ করে দেয়।
অতএব এই জরূরতে ভিডিওকে জায়েয বলা হবে। কিন্তু বেশি আকর্ষণ ও বেশি আবেদন- এগুলোকে আদৌ ‘জরূরত’ আখ্যায়িত করা ঠিক কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে বৈ কি। ফিকহের পরিভাষায় যেকোনো রকম প্রয়োজন বা হাজতকেই জরূরত (ضرورة) বলা হয় না। ফিকহের পরিভাষায় জরূরত বলা হয়- কোন গত্যন্তর না থাকাকে। যা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই, যা না হলে চলেই না তা-ই হল জরূরী। যেমন শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে সালেহ القواعد والضوابط الفقهية المتضمنة للتيسير গ্রন্থে বলেছেন,

إن المحرم يصبح مباحًا إذا عرض للمكلف ضرورة تقتضي ذلك؛ بحيث لا تندفع تلك الضرورة إلا بارتكاب ذلك المحرّم.

অর্থাৎ হারাম বিষয় তখনই মুবাহ হয় যখন শরীয়তের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তির সামনে পেশ আসা কোন জরুরত তার তাগাদ করে এমনভাবে যে, সেই হারাম করা ছাড়া সেই জরুরত মেটে না।
বস্তুত ফিকহের পরিভাষায় জরূরত অনন্যোপায় অর্থে, অপারগতার অর্থে, বাধ্য-বাধকতার অর্থে, যা না হলে চলেই না সে অর্থে। যেমন: যা না করলে প্রাণ যাবে বা মারাত্মক রোগের আশংকা দেখা দিবে কিংবা যা না করলে কোন ফরয ওয়াজেব বর্জিত হওয়া অবধারিত হয়ে দাঁড়াবে ইত্যাদি। যেনতেন প্রয়োজনকেই ‘জরূরত’ বলা হয় না। যেমন আলেমগণ “জরূরত”-এর ব্যাখ্যায় প্রদত্ত নিম্নের বক্তব্যগুলো লক্ষ করতে পারেন-

قال الجصاص: الضرورة هي خوف الضرر … إماعلى نفسه أو على عضو من أعضائه. (أحكام القرآن للجصاص)
قال ابن تيمية : “الضرورة: التي يحصل بعدمها حصول موت أو مرض أو العجز عن الواجبات إلخ. (مجموع الفتاوى).

‘জরূরত’-এর এ ব্যাখ্যাকে সামনে রাখলে কি বেশি আকর্ষণ ও বেশি আবেদনকে ‘জরূরত’ আখ্যায়িত করা যায়? আদৌ না। কারণ ভিডিও-র পরিবর্তে অডিও-র দ্বারা বা কোন লেখা দ্বারা যখন কাজ চালিয়ে নেয়া যায় তখন ভিডিও “এটা না হলে চলেই না”- এমন পর্যায়ের জিনিস রইল না। অতএব তার ভিত্তিতে ভিডিওকে জায়েয বলা যায় কীভাবে? তবুও সিংহভাগ উলামা হযারাত যেহেতু এটাকেই জরূরত আখ্যায়িত করে ভিডিওকে জায়েয বলছেন বা জায়েয ভাবছেন, তাই তাদের বিরোধিতা না করেও অন্তত এটা বলতেই হচ্ছে যে, “তাকওয়া হল বিরত থাকা”- এতটুকু অবশ্যই বলতে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তা বলা হচ্ছে না। আর তা না বলার কারণে জরূরত প্রয়োজন (হাজত) কোনোকিছু ছাড়াই বল্গাহীনভাবে ভিডিওর ব্যবহার চলছে। একজন আলেমের বিয়ে হচ্ছে, তার ভিডিও পর্যন্ত ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ বউয়ের সাথে বিনোদন করে তার ভিডিও পর্যন্ত ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ কোথাও ঘুরতে গিয়ে নৌকায় চড়েছে, বা পিকনিক করেছে তার ভিডিও ছেড়ে দিচ্ছে। মাঠে হাল চালাচ্ছে তার ভিডিও ছাড়ছে। কেউ তার ছোট্ট বাচ্চার সাথে দুষ্টুমি করেছে তার ভিডিও ছেড়ে দিচ্ছে। এরকম বল্গাহীনভাবে কত রকমের ভিডিও ছাড়া হচ্ছে তার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। আলেম পরিচয় প্রদানকারী যারা এগুলো করছেন তাদের কথাই বলছি। এগুলোতে দ্বীনী কী জরূরত বা প্রয়োজন রয়েছে? যদি তাকওয়ার দিকটি প্রচার করা হত, তাহলে অবস্থার এতটা অবনতি ঘটত না, এরকম বল্গাহীন ভিডিও চর্চার রেওয়াজ ঘটত না।
উল্লেখ্য: একান্তই যদি অতিরিক্ত আকর্ষণ সৃষ্টির চিন্তা জাগে তাহলে অডিও-র সাথে প্রাণীর ছবি ছাড়া কোন ভিডিও দেয়া যেতে পারে। তাতে যদি কিছু আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।

স্থির ছবি প্রসঙ্গ
স্থির ছবির মধ্যে যেগুলো প্রিন্ট কপিতে আনা হয় সেগুলোকে কেউ জায়েয মনে করছেন কি না তা জানা নেই। তবে যেগুলো ডিজিটাল ছবি সেগুলো প্রিন্ট কপিতে আসার আগ পর্যন্ত জায়েয বলেই অনেকে ভাবছেন। এই ডিজিটাল ছবির মধ্যে কিছু আছে যা বিভিন্ন দ্বীনী আর্টিকেল, দ্বীনী পোস্ট বা সাক্ষাৎকারের শুরুতে দেয়া হয় এগুলোকে অনেকেই জায়েয ভাবছেন।
যারা এসব স্থির ছবিকে নিছক ডিজিটাল ছবি হওয়ায় জায়েয ভাবছেন, তাদের যুক্তিও পূর্বের দু’টো যুক্তি। যথা:

১- ডিজিটাল ছবি প্রিন্ট কপিতে আসার আগ পর্যন্ত স্থির ছবি নয়। প্রিন্ট কপিতে আসার আগ পর্যন্ত তার কোন ইস্তিকরার (استقرار) তথা স্থিতি নেই। বরং মেমোরিতে কিছু পিক্সেল (Pixel) থাকে, অর্ডার দিলে সেগুলো জড় হয়ে ছবি শো করে। মূল মেমোরিতে কোন স্থির ছবি থাকে না। পিক্সেল বলতে বোঝায় কোন গ্রাফিক ছবির ক্ষুদ্রতম অংশ বা বিন্দু। মেমোরিতে স্থির ছবি থাকে না বরং ছবির পিক্সেল থাকে। সহজ অভিব্যক্তিতে বলা যায় মেমোরিতে কিছু ইলেক্ট্রোনিক্স কণা থাকে। অর্ডার দিলে সেগুলো জড় হয়ে ছবি শো করে।

কিন্তু এখানে এক নম্বর কথা হল মেমোরিতে ছবি কী অবস্থায় থাকে বা মেমোরিতে ছবির কী থাকে তা নিয়ে আলোচনা নয়, আলোচনা হল স্ক্রিনে যে ছবি শো হয় তা নিয়ে। আর স্ক্রিনের ছবি তো স্থিরই, সেটাকে কণা নয় বরং ছবিই মনে হয়। দুই নম্বর কথা হল এখানেও পূর্বের ন্যায় এরূপ বলার অবকাশ রয়েছে যে, ছবি স্থির হোক বা স্থির না হোক যে খারাবিগুলোর কারণে ছবি নিষিদ্ধ হয়েছে সে খারাবিগুলো উভয় রকম ছবিতেই বিদ্যমান, যেমনটা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব প্রিন্ট ছবির ন্যায় ডিজিটাল ছবিও নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। অন্তত এতটুকু তো বলতেই হবে যে, এক যুক্তিতে না-জায়েয মনে না হলেও আর এক যুক্তিতে না-জায়েয মনে হয়। অতএব জায়েয হওয়া এবং না-জায়েয হওয়া উভয়টার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ফিকহ ও ফতোয়ার উসূল (মূলনীতি) অনুযায়ী কোন বিষয়ে জায়েয হওয়া ও না-জায়েয হওয়া উভয় দিকের সম্ভাবনা থাকলে সেখানে তাকওয়া হল না-জায়েয হওয়ার দিকের উপর আমল করা। সেমতে এরূপ ছবি থেকেও বিরত থাকা তাকওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাকওয়ার দিককে একেবারে পশ্চাতে ফেলে যেভাবে বল্গাহীন ছবি চর্চায় নামা হয়েছে তা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।

২- ডিজিটাল স্থির ছবি যেগুলো বিভিন্ন দ্বীনী আর্টিকেল, দ্বীনী পোস্ট বা সাক্ষাৎকারের শুরুতে দেয়া হয় এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল বা পোস্ট ইত্যাদির আকর্ষণ ও আবেদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ যুক্তি যে খুব একটা জোরালো নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভিডিও-র ছবি নড়াচড়া দেখে না হয় কিছুটা আবেদন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু স্থির, নড়েচড়ে না-এমন ছবি দেখলে পাঠকদের মনে বক্তব্যের ব্যাপারে কীইবা আবেদন বৃদ্ধি পায়। এটা নিতান্তই ঠুনকো যুক্তি।

তবে একটা কথা বলে রাখতে হচ্ছে যে, পাসপোর্ট বা ভিসা সংক্রান্ত বিষয়াদিতে যে ছবি ব্যবহার তা জরূরতের পর্যায়ভুক্ত। এগুলোর সঙ্গে বিদেশ গমনকারী ব্যক্তির এবং যে দেশে সে গমন করবে সে দেশের নিরাপত্তার বিষয়ও জড়িত। ফলে তা বৈধ। এমনিভাবে অন্যান্য জরুরতের ক্ষেত্রেও ছবি ব্যবহার বৈধ। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় প্রয়োজনে বিদেশীদের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকার বা অনুষ্ঠানাদি হয়, যেখানে ছবি থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভবও হয় না, সেগুলোকেও বৈধতার পর্যায়ে ফেলা যাবে। কারণ সেখানে একদিকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর বিষয় হলে তা জরূরতের পর্যায়ে পড়তে পারে, আবার এরূপ অনুষ্ঠানাদিতে ছবি ভিডিও এড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা অপারগতাও থাকে।

কিন্তু এরকম কোন জরূরত বা অপারগতা ছাড়া, এমনকি কোনো প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই নিছক বিনোদনের জন্য বা নিজের চেহারা প্রদর্শনের জন্য ছবি আপলোড করে থাকেন। যেমন অনেকে ফেসবুক টুইটার ইত্যাদির প্রোফাইলে ছবি যুক্ত করেন, আবার কয়েকদিন পর পর নতুন পোজ দিয়ে ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার আপডেট করেন। কেউ কেউ কোন লেখা ছাড়াই খামাখা চেহারার জেল্লা দেখানোর জন্য ছবি পোস্ট করেন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এটা সেটা করে সেগুলোর পিক দেন বা ছবি দিয়ে স্টোরি ছাড়েন। একজন প্রসিদ্ধ আলেম এসেছেন তো কেউ তার সঙ্গে সেলফি তুলে রাখছেন, এমনকি গর্বের সাথে সেই সেলফি তোলার বিবরণ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পোস্টও ছাড়ছেন। এগুলো কী চলছে? এগুলোর কী দ্বীনী প্রয়োজন রয়েছে? যারা এমনটা করছেন তারা সেটাকে জায়েয ভেবে করছেন নাকি না-জায়েয জেনেও করছেন আল্লাহই ভাল জানেন। তবে ডিজিটাল ছবি হওয়ার তথা স্থিতি না থাকার যুক্তিতে জায়েয হওয়ার সম্ভাবনা কেউ বললেও যেহেতু না-জায়েয হওয়ার দিকও রয়েছে তাই উলামায়ে কেরামের তাকওয়া অনুসারী হয়ে এ থেকে বিরত থাকাই কাম্য ছিল।

এভাবে তাকওয়ার দিকটি উপেক্ষা করে ফ্রি স্টাইলে ছবি ছাড়াকেও যদি জায়েয বলে দেয়া হয়, তাহলে উলামায়ে উম্মত এ যাবত সহীহ হাদীছের ভিত্তিতে ছবি হারাম হওয়ার যে ফতোয়া দিয়ে আসছেন তার প্রয়োগক্ষেত্র আর বাকি রইবে কোথায়? হাদীছের ওঈদ প্রয়োগের ক্ষেত্র বাকি রইবে কোথায়? শুধু ছবির প্রিন্ট কপিকে প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে বাকি রাখা হবে? তা এই যুগে অফিস আদালত সর্বত্র প্রিন্ট ছবির প্রয়োজন হয়, যেকোনো মুহূর্তে এরকম ছবির প্রয়োজন দেখা দিতে পারে- এই যুক্তিতে যদি সব সময় কাছে প্রিন্ট ছবি রাখাকে এবং আরও আগে বেড়ে সব জায়গায় ছবি ব্যবহারকেও জায়েয বলে দেয়া হয় বা মনে করে নেয়া হয়? বোধ হয় কিছু আলেম এমনটাই ভাবতে শুরু করেছেনও। ওয়াজের পোস্টারে তাদের ছবি আসতে শুরু করেছে, যার প্রতিবাদও তাদের পক্ষ থেকে আসছে না। নাউযু বিল্লাহ! এটা কি দ্বীনের ক্ষেত্রে মুদাহানাত নয়?
হাদীছের সেই কঠিন বক্তব্যকে আমরা কীকরে সর্বতোভাবে এড়িয়ে যেতে পারি, যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করে ইরশাদ করেছেন-

إن أشد الناس عذابا عند الله يوم القيامة المصورون. (رواه البخاري في صحيحه برقم ٥٩٥٠ ومسلم في صحيحه برقم ٥٦٥٩)

অর্থাৎ, অবশ্যই কেয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট লোকদের মাঝে সবচেয়ে বেশি কঠিন শাস্তি হবে তাদের যারা চিত্র (এমনিভাবে মূর্তি/ভাস্কর্য) বানায়। (বোখারী: হাদীছ নং ৫৯৫০ ও মুসলিম: হাদীছ নং ৫৬৫৯ )
অতএব তাকওয়া তথা খোদাভীতিকে উপেক্ষা করে হুজুগের প্রবাহে ভেসে যাওয়া বড়ই খতরার বিষয়। যদি উলামায়ে কেরামই তাকওয়াকে উপেক্ষা করে এভাবে হুজুগের প্রবাহে ভেসে চলেন, তাহলে সাধারণ মানুষকে তাকওয়ার কথা বলার জন্য রইবে কারা!
তাই ভিডিও ডিজিটাল ছবি জায়েয হওয়ার প্রবক্তা উলামায়ে কেরামের কাছে নিবেদন- মাসআলাটিতে নজরে ছানী করুন। আপাতত অন্তত এতটুকু অবশ্যই বলুন, তাকওয়া হল এসব ভিডিও ছবি থেকে বিরত থাকা।

وما عليناإلاالبلاغ.

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যদি উসূল ও দালায়েলের ভিত্তিতে আমার বক্তব্যের খণ্ডনে এবং ডিজিটাল ছবি ও ভিডিও অবাধে জায়েয হওয়ার স্বপক্ষে কোন মুহাক্কিক আলেমের অকাট্য বক্তব্য সামনে আসে, তাহলে আমার বক্তব্যে সংশোধনী আনতে আমার কোনোরূপ জিদ থাকবে না ইনশা আল্লাহ।

اللهم أرنا الحق حقا وارزقنا اتباعه وأرنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه.

Leave a Reply