You are currently viewing মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন (পর্ব-৭)

মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন (পর্ব-৭)

লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, প্রগতি ও বিনোদন প্রসঙ্গ

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :

বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল- আপনারা প্রায়শই পাঁচটা কথার খুব অবতারণা করে থাকেন। সেগুলো হচ্ছে- ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, প্রগতি ও বিনোদন। এ পাঁচটা কথার পরিধি ও যথার্থতা নিয়ে একটু ভেবে দেখবেন।
নিম্নে বিষয় পাঁচটি সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্নভাবে কিছু কথা পেশ করলাম।

(১) ব্যক্তি স্বাধীনতা
ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্বন্ধে পূর্বে ৫ম পর্বে কিছু আলোচনা পেশ করেছি, যার সারকথা হল অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্তি স্বাধীনতা আখ্যায়িত হতে পারে না। অন্যথায় কেউ চুরি -ডাকাতি, খুন-খারাবি, ছিনতাই, স্মাগলিং, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যকরণ ইত্যাদি অন্যায় যেকোনো কিছু ইচ্ছা করতে চাইলে তার কোনটাতে বাধা দেয়া যাবে না। কারণ সে বলবে, এটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। বস্তুত কোন অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি স্বাধীনতা নয় বরং তা স্বেচ্ছাচারিতা আখ্যায়িত হয় এবং প্রত্যাখ্যাত হয়। অতএব ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে নারী যার কাছে ইচ্ছা তার দেহ সপে দিতে পারবে না। যার হাত ধরে ইচ্ছা যত্রতত্র গমন ও যা ইচ্ছা করতে পারবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে মদ, গাঁজা, ভাং, হেরোইন সেবন করা যাবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে গান-বাদ্য নাচ-ড্যান্স চলবে না। কারণ এগুলো অন্যায় কাজ। ক্ষতিকর কাজ। আর ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অন্যায় ও ক্ষতিকর কাজকে বৈধ করে নেয়ার কোন সুযোগ নেই, থাকতে পারে না। এটা স্বত:সিদ্ধ কথা যে, Freedom can not be granted in all cases. এগুলো কেন অন্যায়, এগুলো কেন ক্ষতিকর তার বিশদ বিবরণ পূর্বের পর্বে (পর্ব-৬ য়ে) প্রদান করা হয়েছে।

(২) বাক স্বাধীনতা
অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতা আখ্যায়িত হয়ে বৈধ বলে স্বীকৃতি পেতে পারে না, তদ্রূপ অন্যায় কথা বলার স্বাধীনতাও বাক স্বাধীনতা আখ্যায়িত হয়ে বৈধ হয়ে যেতে পারে না। অন্যথায় কাউকে গালিগালাজ করা, কাউকে কটুক্তি করা, পরনিন্দা ইত্যাদি যেকোনো অন্যায় ধরনের কথা কেউ বলতে চাইলে তার কোনটাতে বাধা দেয়া যাবে না। কারণ সে বলবে, এটা আমার বাক স্বাধীনতা। বস্তুত কোন অন্যায় কথা বলার ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে বাক স্বাধীনতা বলে স্বীকৃত নয়। কোন মহান কিছুর বিরুদ্ধে বলা বাক স্বাধীনতা বলে স্বীকৃত নয়। এজন্যই বড় ও মহান ব্যক্তি সত্তার বিরুদ্ধে কিছু বলাকে আইনত অপরাধই গণ্য করা হয়ে থাকে। সেমতে রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যায় সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মত অপরাধ বলে গণ্য হয়। এটাকে বাক স্বাধীনতার আওতায় এনে ক্ষমা করা হয় না। অতএব বাক স্বাধীনতার যুক্তি দিয়ে মহান নবী, মহান কিতাব কুরআন, এমনকি মহান খোদার বিরুদ্ধে কটুক্তি করাকে বৈধ করার চেষ্টা কোনোভাবেই স্বীকৃতি পেতে পারে না। পূর্বে উল্লেখিত স্বত:সিদ্ধ কথাটি পুনরায় উল্লেখ করছি- Freedom can not be granted in all cases.

(৩) নারী স্বাধীনতা
বুদ্ধিজীবীগণ ‘নারী স্বাধীনতা’ বলে ঠিক কী বুঝাতে চান, কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বুঝাতে চান, তা তারা খুব একটা খোলাসা করে বলেন না। অন্তত আমি তেমন পরিষ্কার বর্ণনা কোথাও দেখিনি। তবে এতটুকু স্পষ্ট যে, নারীদের ইসলামী বিধি-বিধানের আওতায় চলতে বাধ্য করাকে তারা নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করেন। অর্থাৎ, নারীদের হিজাবের বিধান মেনে চলতে, পরপুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা না করতে ও বেহায়া বেলেল্লাপনা বর্জন করতে বাধ্য করাকে তারা নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করেন। বুদ্ধিজীবীগণ চান এসব ক্ষেত্রে নারীকে অবাধে ছেড়ে দিতে হবে। কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা যাবে না। কিন্তু কথা হল কোন স্বাধীনতা যদি ক্ষতিকর পরিণতি ডেকে আনে, অশুভ পরিণতি দাঁড় করায়, তাহলে সেই স্বাধীনতা প্রদান করা কি সংগত? আদৌ নয়। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে খেলাধুলা ঘোরাঘুরি করতে চাইলে অবশ্যই গার্জিয়ানরা তাতে বাধা দিবে। এই বাধা দেয়াকে কেউ ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাধা বলবে না। কারণ, এই স্বাধীনতা তাদের জীবনে খারাপ পরিণতি দাঁড় করাবে। এবার বিবেচনা করে দেখুন বুদ্ধিজীবীদের কথিত নারী স্বাধীনতা আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি যেসব দেশে অবাধে চর্চিত হচ্ছে সেসব দেশে সেই নারী স্বাধীনতা কী পরিণতি দাঁড় করিয়েছে। আজ সেসব দেশে প্রতি বছরে পাঁচ দশ লাখ করে অবৈধ শিশু জন্ম নিচ্ছে। লাখো লাখো কিশোরী বালিকা গর্ভপাত করাচ্ছে। গত শতকের শেষ দিকের জরিপ ছিল গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 13 থেকে 16 বছরের একজন কুমারীও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন অশুভ পরিণতি দাঁড় করানো তথাকথিত নারী স্বাধীনতাকে কোন সুস্থ্য বিবেক সম্পন্ন মুসলমান কীভাবে সমর্থন করতে পারে? মানুষ আর হায়ান জানোয়ারের জীবন ধারায় কী কোনই পার্থক্য থাকবে না? মুমিন মুসলমানের জীবনে তো এই পার্থক্য থাকতেই হবে। কাফেরদের কথা ভিন্ন। তাদের জীবনধারার নিন্দা করে আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ.

অর্থাৎ, যারা কাফের তাদের পানাহার ও তাদের জীবন উপভোগ জীবজন্তুর মত। (সূরা মুহাম্মাদ: ১২)

(৪) প্রগতি
নারী স্বাধীনতা কথাটির ন্যায় ‘প্রগতি’ কথাটি দ্বারাও বুদ্ধিজীবীদের কী উদ্দেশ্য তা তারা খুব একটা খোলাসা করে বলেন না। শুধু বলেন, আলেমরা প্রগতি বিরোধী। কিন্তু আলেমগণ কীকরে প্রগতি বিরোধী হলেন তা তো বোধগম্য নয়। প্রগতি দ্বারা যদি জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি উদ্দেশ্য হয় তাহলে আলেম সমাজ কখন জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিরুদ্ধে বললেন? আর প্রগতি দ্বারা যদি আধুনিকতা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তো আধুনিকতা হলেই তা দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্রহণযোগ্য- এমন তো কোন কথা নেই। আধুনিকতার নামে যদি এমন কিছু চালু হয় যা ক্ষতিকর তাহলে অবশ্যই তার বিরোধিতা করা চাই। আলেম সমাজ যেসব আধুনিকতা ক্ষতিকর শুধু সেসব আধুনিকতারই বিরোধিতা করে থাকেন, সব আধুনিকতার নয়। আর নারীদের বেহায়া বেলেল্লাপনার বিরোধিতা করার কারণে যদি আলেম সমাজকে প্রগতি বিরোধী বলা হয়, তাহলে এ ব্যাপারে আমরা বলতে চাই বেহায়া বেলেল্লাপনা আদৌ কোন প্রগতি নয় বরং তা চরিত্রের অধ:গতি, চরিত্রের বিনাশ সাধন, নৈতিক অধ:পতন। এটাকে প্রগতি আখ্যায়িত করা হলেও তা চরিত্রের অধ:গতি ও চরিত্র বিনাশী হওয়ার কারণে তথা ক্ষতিকর হওয়ার কারণে অবশ্যই তার বিরোধিতা করা উচিত। আলেম সমাজ সেই উচিত কাজটিই করে থাকেন। বুদ্ধিজীবীগণ যদি চরিত্রের অধ:গতি, চরিত্রের বিনাশ সাধন ও নৈতিক অধ:পতনকে মোটেই ক্ষতিকর মনে না করেন, তাহলে তাদের বিবেকের কাছে বিষয়টা ন্যাস্ত করা গেল। তাদের কাছে নিবেদন থাকবে- চরিত্রের অধ:গতি, চরিত্রের বিনাশ সাধন, নৈতিক অধ:পতন ইত্যাদি কথাগুলোকে অভিধান থেকে একেবারেই মুছে ফেলবেন না। ভাল আর মন্দকে সমান বিবেচনা করবেন না। আল্লাহর বাণী-

وَلَا تَسۡتَوِي ٱلۡحَسَنَةُ وَلَا ٱلسَّيِّئَةُ.

অর্থাৎ, ভাল আর মন্দ সমান নয়। (সূরা হা-মীম-আসসাজদাহ: ৩৪)

(৫) বিনোদন
বুদ্ধিজীবীগণ বিনোদন বা চিত্তবিনোদন-এর যুক্তিতে অনেক কিছুকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। বিনোদন অর্থ আনন্দ, খুশি। তা মানুষের জীবনে একটু আধটু আনন্দ ফূর্তির প্রয়োজন তো কেউই অস্বীকার করতে পারে না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হাস্য রসিকতা করেছেন। বিবিদের সঙ্গে আনন্দ ফূর্তি করেছেন। এ অর্থে তিনিও চিত্তবিনোদন করেছেন। তবে তার চিত্তবিনোদনের একটা চৌহদ্দি ছিল। বিধিবদ্ধতার চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই তিনি তা করেছেন। বস্তুত চিত্তবিনোদনের একটা চৌহদ্দি থাকতে হবে। সেই চৌহদ্দির বাইরে চিত্তবিনোদন বৈধতা পাবে না। অন্যথায় কেউ যদি বিকৃত রুচির অধিকারী হওয়ায় মানুষ খুন করে কিংবা মানুষকে নির্যাতন করে চিত্তসুখ অনুভব করে তাহলে সেটাকেও চিত্তবিনোদনের যুক্তিতে বৈধতা দেয়ার প্রশ্ন উঠবে। কেউ যদি অন্যের ধন-সম্পদ গ্রাস করে আনন্দ পায় তা কি স্বীকৃতি পাবে? কেউ যদি কাউকে অপমান করে আনন্দ পায় তা কি স্বীকৃতি পাবে? নিশ্চয়ই না। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই বলা হবে কেউ কোন কিছুতে আনন্দ পেলেই তা স্বীকৃতি পাবে না। অবশ্যই তার জন্য একটা বিধিবদ্ধতা থাকতে হবে। সেই বিধিবদ্ধতাই হল চৌহদ্দি যার মধ্যে থেকে চিত্তবিনোদন চর্চিত হতে পারবে। সেই চৌহদ্দি হল শরীয়তের চৌহদ্দি। অতএব চিত্তবিনোদনের নামে অন্যের আইল ঠেলে পয়মালি করা পর্যন্ত ফ্রি সেক্স থিওরির সবকিছু অনুশীলন কোনোভাবেই স্বীকৃতি পাবে না। কোন মুসলমান তা স্বীকৃতি দিতে পারে না। সেরূপ চিত্তবিনোদন প্রকৃতপক্ষে চিত্তবিনোদন নয়, সেটা হল শয়তানের অনুসরণ। কুরআনে কারীম আমাদেরকে এই শিক্ষাই প্রদান করে। ইরশাদ হয়েছে,

إِنَّمَا يَأْمُرُكُم بِٱلسُّوٓءِ وَٱلْفَحْشَآءِ.

অর্থাৎ, শয়তান তোমাদেরকে মন্দ কাজের ও অশ্লীলতা চর্চার নির্দেশ দেয়। (সূরা বাকারা: ১৬৯)

Leave a Reply