You are currently viewing মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন (পর্ব-৫)

মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন (পর্ব-৫)

লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد:

বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল-
আলেমদের সঙ্গে মূল যে কয়টা বিষয় নিয়ে আপনাদের বিরোধ তা একটু পুন:বিবেচনা করে দেখুন।
আলেমদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের বিরোধ অনেক বিষয়ে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে মূল বিরোধ মাত্র দু’টো বিষয়ে। তা হল:

১. নারীদেরকে পর্দাহীন করা হবে কি না
নারীদের হিজাবের বিধান, পরপুরুষের সঙ্গে নারীদের অবাধ মেলামেশা না করার বিধান, নারীদের শিক্ষা, নারীদের চাকরি, নারীদের অধিকার, তাদের উন্নতি অগ্রগতি, নারী প্রগতি প্রভৃতি অনেকগুলো বিষয়ে উলামায়ে কেরামের সাথে বুদ্ধিজীবীদের যে বিরোধ তার মূল হল মাত্র একটি। তাহল বুদ্ধিজীবীগণ নারীদের শিক্ষাদীক্ষা, নারীদের অধিকার, তাদের চাকরি-বাকরি উন্নতি অগ্রগতি সবকিছুর জন্য নারীদেরকে পর্দার বাইরে আনতে চান। আর উলামায়ে কেরাম কুরআন সুন্নাহর বিধান মোতাবেক নারীদেরকে পর্দার মধ্যে রেখেই তাদের সবকিছু করাতে চান। উলামায়ে কেরাম নারীদের শিক্ষার বিরোধী নন, তারা নারীদের উন্নতি অগ্রগতির বিরোধী নন, অনন্যোপায় হলে নারীগণ চাকরিও করতে পারবে এ বিষয়েও তারা ইতিবাচক মত পোষণ করেন। নারীদের অধিকারও ইসলাম পর্যাপ্ত দিয়েছে- এ নিয়েও উলামায়ে কেরামের ভিন্ন কোন মত নেই। উলামায়ে কেরামের একটিই বক্তব্য, আর সেটা কুরআন হাদীছেরই বক্তব্য যে, নারীদের সবকিছুই হতে হবে শরীয়ত নির্দেশিত পর্দার বিধান রক্ষা করে, যাতে করে নারীদের সতীত্বের সুরক্ষা হয়, তাদের সতীত্ব সম্ভ্রম ঝুঁকিতে না পড়ে। নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম সুরক্ষার প্রশ্নে তারা আপোষহীন। কারণ ইসলাম নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম নষ্ট করা কোনোক্রমেই মেনে নেয় না, এমনকি তাদের সতীত্ব সম্ভ্রমকে ঝুঁকিতে পর্যন্ত ফেলতে চায় না। পক্ষান্তরে বুদ্ধিজীবীগণ নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদকে আলোচনায়ই আনতে নারাজ। তারা নারীদের নিয়ে অনেক কিছুই বলেন, কিন্তু কোনোভাবেই নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম নষ্ট করা যাবে না- এমন কথা তারা কখনোই বলেন না। কখনও নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রমের হানি হলে তাদেরকে কার্যকরভাবে সোচ্চারও হতে দেখা যায় না, এমনকি সিরিয়াল ধর্ষণ ও গণ ধর্ষণের মত ঘটনার বেলায়ও না, যা এই ধারণা উদ্রেক করে দেয় যে, তারা নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম হানি বন্ধ হোক তা চান না এবং নারীদের সতীত্ব সম্ভ্রম সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক তা পছন্দ করেন না। ভিন্ন ভাষায় বলা যায় তারা খাহেশাতে নফছানী চরিতার্থ করার পথকেই সুগম রাখতে চান। মূলত বুদ্ধিজীবীদের সাথে উলামায়ে কেরামের বিরোধ এই পয়েন্টে।
বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে বলছি, যুক্তি-তর্ক দিয়ে বা ওয়াজ-নসীহত করে আমরা আদৌ আপনাদেরকে খাহেশাতে নফছানী থেকে ফিরিয়ে ইসলামের অনুকূল পক্ষে আনতে পারব কি না জানা নেই। কারণ মস্তিষ্কে খাহেশাতে নফছানির চাপ থাকলে সেখানে কোন যুক্তি বা নসীহত উপদেশ তেমন কাজ করে না, যার বিবরণ পূর্বের সংখ্যায় দিয়েছি। তাই আপনাদের কাছে নিবেদন- আপনারা নিজেদের মনকে নিরপেক্ষ অবস্থানে এনে তার কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন আপনারা আপনাদের মা বোনদের সতীত্ব সম্ভ্রম রক্ষার উদ্যোগে ব্রতী হবেন নাকি অবলীলায় তাদের সতীত্ব সম্ভ্রম ধ্বংসের তৎপরতায় শরীক থাকবেন বা তাতে নীরবতা পালন করে যাবেন? হাদীছের ভাষায়-

استفت قلبك. (رواه أحمد في مسنده برقم ١٨٠٣٥ وقال النووي في الأذكار: حديث حسن.)

অর্থাৎ, তুমি তোমার মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ। (মুসনাদে আহমদ: হাদীছ নং ১৮০৩৫)

২. অন্যায় কাজের স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা বিবেচিত হতে পারে কি?
উলামায়ে কেরামের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের বিরোধের আর একটা মূল বিষয় হল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিষয়। বুদ্ধিজীবীগণ ভয় পান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে (তাদের কথিত) ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যাহত হবে। কেননা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে সিনেমা, গান-বাদ্য, নাচ-ড্যান্স, নারীদের অবাধ বিচরণ, মদ সেবন, ধর্ম ও আল্লাহ রসূলকে নিয়ে বল্গাহীন কথাবার্তা বলার সুযোগ ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যাহত হবে। বুদ্ধিজীবীগণ এগুলো করতে পারাকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা আখ্যায়িত করে থাকেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে সেই স্বাধীনতা খর্ব হবে ভেবে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যেকোনো তৎপরতার বিরোধিতা করে থাকেন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে তার কাউন্টার করার চেষ্টা করে থাকেন।
উলামায়ে কেরাম কারও প্রকৃত ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী নন। উলামায়ে কেরামের বক্তব্য হল- সিনেমা, গান-বাদ্য, নাচ-ড্যান্স, নারীদের অবাধ বিচরণ, মাদক সেবন, ধর্ম ও আল্লাহ রসূলকে নিয়ে বল্গাহীন কথাবার্তা বলা ইত্যাদি অন্যায়। আর অন্যায় কাজ করার স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে স্বীকৃতি পেতে পারে না। অন্যথায় কেউ চুরি -ডাকাতি, খুন-খারাবি, ছিনতাই, স্মাগলিং, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যকরণ ইত্যাদি অন্যায় যেকোনো কিছু করতে চাইলে তার কোনটাতে বাধা দেয়া যাবে না। কারণ সে বলবে, এটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। বস্তুত কোন অন্যায় কাজ করার ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি স্বাধীনতা নয় বরং তা স্বেচ্ছাচারিতা আখ্যায়িত হয়, যা অপরাধ। প্রকৃত ব্যক্তি স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতাকে একসাথে গুলিয়ে না ফেলা চাই।
যাহোক উলামায়ে কেরাম ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে যখন বিষয় দু’টো নিয়ে বিরোধ, আর এই বিরোধ নিরসনের জন্য বুদ্ধিজীবীগণ কুরআন সুন্নাহর গাইড মেনে নিচ্ছেন না, তখন বিরোধ নিরসনের জন্য একটা আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। সে আদালত হল বিবেক। বিবেক আল্লাহর দেয়া এমন একটা জিনিস যা সুস্থ্য থাকলে বিবাদপূর্ণ বিষয়াদির ক্ষেত্রে ফয়সালা দিতে পারে যে, কোনটি সঠিক ও গ্রহণীয় আর কোনটা অঠিক ও বর্জনীয়। তবে বিবেক থেকে সঠিক ফয়সালা পাওয়ার জন্য শর্ত এই যে, বিবেক সুস্থ্য থাকা চাই। বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন- আপনারা আপনাদের বিবেককে সুস্থ্য অবস্থানে এনে তার কাছে দু’টো প্রশ্ন করুন। (১) সিনেমা, গান-বাদ্য, নাচ-ড্যান্স, নারীদের অবাধ বিচরণ, মদ গাঁজা সেবন, ধর্ম ও আল্লাহ রসূলকে নিয়ে বল্গাহীন কথাবার্তা বলা ইত্যাদি প্রকৃতপক্ষেই গর্হিত কি না। (২) যদি গর্হিতই হয়ে থাকে, তাহলে গর্হিত কাজের স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা আখ্যায়িত হতে পারে কি না। পূর্বোক্ত হাদীছটির কথা আবারও উল্লেখ করছি, “তুমি তোমার মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ।” উল্লেখ্য, বিবেককে জিজ্ঞেস করাও মনকেই জিজ্ঞেস করা। বিবেক মনেরই অংশ বিশেষ।
তবে উল্লেখ্য যে, আদালত থেকে সঠিক রায় পেতে চাইলে আদালতের সামনে উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পূর্ণাঙ্গরপে উপস্থাপিত হওয়া আবশ্যক। এখন উপরোক্ত বিষয়াদির উপযোগিতার অনকূলে বুদ্ধিজীবীদের কোনো যুক্তি-প্রমাণ থেকে থাকলে তা তো তাদের জানাই আছে, তবে সেগুলোর অনুপযোগিতার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের কাছে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক কি কি বক্তব্য রয়েছে তা বুদ্ধিজীবীদের কাছে স্পষ্ট নাও থাকতে পারে। তাই বুদ্ধিজীবীদের অবগতির জন্য সেগুলো তুলে ধরতে চাই। যাতে করে তারা বিবেক নামক আদালতের সামনে উভয় পক্ষের সবকিছু পূর্ণাঙ্গরূপে পেশ করতে সক্ষম হন এবং বিবেক থেকে সঠিক রায় লাভ করতে পারেন। কিন্তু উলামায়ে কেরামের কাছে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক কি কি বক্তব্য রয়েছে তা সব এখানে পেশ করতে গেলে এ লেখাটি বেশ বড় হয়ে যাবে। তাই পরবর্তী সংখ্যায় (বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন পর্ব-৬ য়ে) সেগুলো তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন থাকবে- আপনাদের বিবেকের সামনে উভয় পক্ষের যুক্তি ও বক্তব্য পেশ করে তার কাছ থেকে ফয়সালা নিয়ে নিবেন এসব ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের অবস্থান তথা ইসলামের অবস্থান সঠিক না আপনাদের অবস্থান।

Leave a Reply