You are currently viewing দেশ ও জাতির উন্নয়নে আলেম সমাজের ভূমিকা

দেশ ও জাতির উন্নয়নে আলেম সমাজের ভূমিকা

লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :

কিছু লোক প্রশ্ন তুলে থাকে আলেম সমাজ দেশ ও জাতির উন্নয়নে কী করে থাকেন? এর উত্তর হল- দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়নের জন্য মৌলিকভাবে যা যা করার প্রয়োজন আলেম সমাজ তার সবটাই করে থাকেন। কিন্তু যারা প্রশ্ন তুলে থাকে তারা হয়তো দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন বলতে কী বুঝায় সেটাই বোঝে না, বরং উল্টো যেটা প্রকৃত উন্নয়ন নয় সেটাকেই উন্নয়ন বুঝে বসে থাকে, ফলে আলেম সমাজের কৃত প্রকৃত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডগুলো তাদের কাছে বিবেচ্য হয় না। কিংবা তাদের চোখের উপর ইসলাম ও উলামা বিদ্বেষের পর্দা সেঁটে থাকে, ফলে তারা আলেম সমাজের কৃত প্রকৃত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডগুলো দেখতে পায় না।
অভিধানের বর্ণনা অনুযায়ী ‘উন্নয়ন’ (Development) অর্থ উন্নতি সাধন, প্রবৃদ্ধি ঘটানো, শ্রীবৃদ্ধিকরণ। এই ‘শ্রীবৃদ্ধিকরণ’ কথাটিকে সামনে রেখে সবগুলো অর্থ সমন্বিত করলে সার এই দাঁড়াবে যে, ভাল কিছুর বৃদ্ধি ঘটানোই হচ্ছে উন্নয়ন। মন্দের বৃদ্ধি ঘটানো নয়, বরং ভালোর বৃদ্ধি ঘটানোই হচ্ছে উন্নয়ন। মানব উন্নয়ন হোক, সামাজিক উন্নয়ন হোক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হোক, রাজনৈতিক উন্নয়ন হোক সব উন্নয়নের ক্ষেত্রেই একই কথা- মন্দের নয়, বরং ভালোর বৃদ্ধি ঘটানোই হচ্ছে উন্নয়ন। যেমন ধরুন মানুষের মাঝে অসচ্চরিত্র ও নীতিহীনতা বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়ন নয় বরং চরিত্র ও নীতি নৈতিকতা বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়ন। মানুষকে কুমানুষ বানানো উন্নয়ন নয় বরং মানুষকে সুমানুষ হিসেবে গড়ে তোলা উন্নয়ন। দেশে কুনাগরিকের বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন নয় বরং সুনাগরিকের বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন। এগুলো হচ্ছে মানব উন্নয়ন (Human Development)-এর ক্ষেত্রে কথা। এমনিভাবে সমাজ ও প্রশাসনে দুর্নীতির বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন নয় বরং ন্যায়-নীতির বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন। সমাজে ও বিচার-ব্যবস্থায় জুলুম অবিচারের বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন নয় বরং ইনসাফ ও সুবিচারের বৃদ্ধি ঘটানো উন্নয়ন। সমাজ সদস্যদের মাঝে সৌহার্দ সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়ন। এগুলো হচ্ছে সামাজিক উন্নয়ন (Social Development)-এর ক্ষেত্রে কথা। এমনিভাবে অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি করা উন্নয়ন নয় বরং সুব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি করা উন্নয়ন। এটা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development)-এর ক্ষেত্রে কথা। এমনিভাবে রাজনৈতিক অনৈক্য ও অংশীদারিত্বহীনতা বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়ন নয় বরং ঐক্য ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাওয়া হচ্ছে উন্নয়ন। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক উন্নয়ন (Political Development)-এর ক্ষেত্রে কথা।
এই যখন প্রকৃত উন্নয়ন-এর সংজ্ঞা ও পরিচয়, তাহলে এবার পর্যালোচনা করে দেখুন উন্নয়নের মৌলিক কোন ক্ষেত্র এমন আছে যেখানে আলেম সমাজের ভূমিকা বেশি না রয়েছে।
* সৎ চরিত্র ও নীতি নৈতিকতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে আলেম সমাজের চেয়ে কাদের ভূমিকা বেশি রয়েছে? আলেম সমাজ নবী সা.-এর শিক্ষা প্রচার করেন, যে নবীকে প্রেরণই করা হয়েছিল উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেয়ার জন্য। আলেম সমাজ ছাড়া অন্য কারা নৈতিকচরিত্র শিক্ষাদানে কার্যকর ভূমিকা রাখে? অন্যদের অবস্থা তো এই- কয়েক বছর আগে ভার্সিটির এক শিক্ষিকার মুখ ফসকে বের হয়ে গেল যে, পাঠ্যবই পড়ানো আমাদের দায়িত্ব, নৈতিকচরিত্র শিক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়।
* মানুষকে সুমানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলেম সমাজের চেয়ে কাদের ভূমিকা বেশি রয়েছে? আলেম সমাজ যেসব মানুষ তৈরি করেন তারা হলেন হাফেজে কুরআন, আলেমে দ্বীন, মুফাসসির, মুহাদ্দিছ ও ফকীহ তথা আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরসূরী ও নায়েবে নবী। তারা তৈরি করেন ইমাম ও খতীব, জাতির ধর্মীয় শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক পরিশোধনকারী ব্যক্তিত্ব। তারা তৈরি করেন খাঁটি দ্বীনদার ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। আর আলেম সমাজের তৈরিকৃত এই সব শ্রেণীর মানুষ যে সমাজের সুমানুষ ও আদর্শ মানুষ তা সুস্থ্য বিবেক সম্পন্ন সকলের কাছেই স্বীকৃত। বস্তুত আলেম সমাজ মানুষকে কুরআন সুন্নাহর কিছু আক্ষরিক বিদ্যা শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না। বরং তাদেরকে সেই বিদ্যার প্রতিচ্ছবি আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন।
* দেশের মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলেম সমাজের চেয়ে কাদের ভূমিকা বেশি রয়েছে? আলেম সমাজ যাদেরকে তৈরি করেন সেই হাফেজে কুরআন, আলেমে দ্বীন, মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, ফকীহ, ইমাম, খতীব, খাঁটি দ্বীনদার ও ধর্মপ্রাণ মানুষের মত সুনাগরিক আর কারা বেশি তৈরি করে থাকে?
* প্রশাসনে বিরাজমান দুর্নীতি দূরীকরণ ও সুনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আলেম সমাজের চেয়ে কাদের ভূমিকা বেশি? এই যে লাখো কোটি মানুষ এখনও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করা, কর্তব্য কাজে ফাঁকি না দেয়া, ঘুষ উৎকোচ গ্রহণ না করা, সরকারি অর্থ আত্মসাত না করা ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্নীতি মুক্ত হয়ে থাকছেন এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কাজে ভূমিকা রাখছেন এই দুর্নীতি মুক্ত হওয়ার শিক্ষা তাদেরকে আলেম সমাজই দিচ্ছেন অন্য কেউ নয়।
* সামাজিক সৌহার্দ সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম প্রদত্ত অনন্য শিক্ষা, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম প্রদত্ত অনন্য শিক্ষা আলেম সমাজের চেয়ে আর কারা বেশি প্রচার করে থাকে।
* অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আলেম সমাজের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা অনস্বীকার্য। মিল ফ্যাক্টরি, খামার হ্যাচারি প্রভৃতি অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান অনেকেই গড়ে তুলতে পারে, পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু যে সততা, দায়িত্বনিষ্ঠা ও নীতি-নৈতিকতা ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানেরই আর্থিক সফলতা আসে না, সেই শিক্ষা আলেম সমাজই প্রদান করেন অন্য কেউ নয়। যদিও এ ক্ষেত্রে আলেম সমাজের ভূমিকা রয়ে যায় স্থূল দৃষ্টির অন্তরালে। যার ফলে মনে হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আলেম সমাজের কোনোই ভূমিকা নেই।
আলেম সমাজ শুধু উপরোক্ত কয়েকটি কাজই করেন না। তাদের কাজের পরিধি অনেক ব্যাপক। ইহজগত পরজগত উভয় জগতের সব রকম সফলতা ও কল্যাণের পথ নির্দেশ করে থাকেন তারা।
আলেম সমাজ দেশ ও জাতির উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখেন, তারা দেশ ও জাতির জন্য কী করেন এ গেল তার সংক্ষিপ্ত ডাটা ভিত্তিক বিবরণ। এর প্রত্যেকটি ডাটা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে তার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। জ্ঞনীদের জন্য অল্প কথাই যথেষ্ট হয়ে থাকে।
এতক্ষণ প্রকৃত উন্নয়ন কাকে বলে এবং সে ক্ষেত্রে আলেম সমাজের কি ভূমিকা তার যে বিবরণ পেশ করা হল তা যদি কেউ না মানে বরং মনে করে যে, উন্নয়ন হল বেহায়া বেলেল্লাপনা বৃদ্ধির নাম, উন্নয়ন হল খেল-তামাশা বৃদ্ধির নাম, উন্নয়ন হল নীতি-নৈতিকতার বন্ধন থেকে মুক্তির নাম, উন্নয়ন হল অসচ্চরিত্রের প্রবাহে ভেসে যাওয়ার নাম ইত্যাদি, তাহলে তার উন্নয়ন-এর সংজ্ঞা বুঝতে সমস্যা রয়েছে ধরে নিতে হবে। আর যারা উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট, কলকারখানা, বিল্ডিং ইমারত বৃদ্ধি পাওয়াকে বোঝে তাদের উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণা নিতান্তই সংকুচিত।
وما علينا إلا البلاغ.

Leave a Reply