মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন সাহেব দামাত বারাকাতুহুম দেশের শীর্ষ আলেম, লেখক ও গবেষকদের একজন। বেস্ট সেলার লেখকদের তালিকায়ও তাঁর নাম প্রথম দিকে। বিষয়বস্তু ও মানের বিচারে তাঁর লেখা আলেম ও গর আলেম সর্বশ্রেণীর কাছে বেশ সমাদৃত। ইতোমধ্যে তিনি দিনের মৌলিক এবং জনসাধারণের জন্য দরকারি বেশ কিছু বই জাতিকে উপহার দিয়েছেন। তিনি দরসে হাদিসের পাশাপাশি লেখা ও রচনাকে দীন ও মানবতার খেদমতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীনের লেখক হয়ে ওঠা এবং প্রাসঙ্গিক নানা ভাবনা নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন- শামসুদ্দীন সাদী
➤ আপনার শৈশবকালে আলেমদের মধ্যে বাংলা লেখালেখির চর্চা ছিল না বললেই চলে। সেই সময়ে বাংলা লেখালেখির প্রেরণা পেলেন কীভাবে?
কিছু লেখক এমন থাকেন যারা স্বভাব থেকেই লেখার প্রেরণা পায়। এদেরকে বলা হয় স্বভাবজাত লেখক। প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে পড়ে থাকলেও দেখা যায় এরূপ স্বভাবজাত লেখকরা বাল্যকাল থেকেই কারও প্রেরণা প্রদান ছাড়াই কবিতা ছড়া এটা সেটা লেখা শুরু করে দেয়। স্বপ্রণোদিত হয়েই তারা লেখা শুরু করে। স্বভাবজাত প্রেরণা ছাড়াও বর্তমান জামিউল উলুমিল ইসলামিয়া, মুহাম্মাদপুরের মুহতামিম মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব -যিনি গওহারডাঙ্গা মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব কাশিয়ানী হুজুরের জামাতা, তিনিও আমাদের খুলনার মানুষ। আমরা একসঙ্গে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় লেখাপড়া করেছি। তিনি আমার কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বড় ভাইয়ের মত সম্পর্ক ছিল- তিনিও আমাকে শুরুতে লেখালেখির জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এর জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তাঁর থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছি। সেই সাথে আমি আমার ভেতর থেকেও লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করি।
➤ লেখালেখি শিখতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন এমন কোন ঘটনা আছে কি?
ছাত্রজীবনে লেখালেখি শিখতে গেলে কোথাও কোথাও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা আসেও। কোনো ছাত্র যদি দরসি কিতাবাদি ভালোভাবে পড়াশোনা না করে, তখন শিক্ষকরা লেখালেখি দরসের বাইরের বই-পত্র পড়া ইত্যাদিতে বাধা দেন। কারণ সেটা হয়ে যায় ফরজ বাদ দিয়ে নফল নিয়ে টানাটানি করা এবং লুঙ্গি খুলে পাগড়ি বাঁধার মত, যা ঠিক নয়। তাই তারা বাধা দেন। কিন্তু উস্তাদরা যদি বুঝতে পারেন যে, ছাত্রটি দরসি লেখাপড়ায় ত্রুটি করে না, ফলাফল ভাল করে, এরপর অতিরিক্ত লেখাজোখার প্রশিক্ষণ নেয়, এ লাইনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে, তখন সে উস্তাদরা তাকে বাধা দেন না। আমি আমার কোনো উস্তাদ থেকে এ রকম বাধা পাইনি। আল-হামদু লিল্লাহ দরসী মেহনতে ত্রুটি না রাখার চেষ্টা করতাম। আমি আমার নিজের স্থান থেকে লেখালেখির অনুশীলন করতাম। অনেক উস্তাদ জানতেনও না। দুই-একজন উস্তাদ জানতেন, তারা বাধা দিতেন না।
নিচের দিকের জামাতগুলো আমি পড়েছি গওহারডাঙ্গা মাদরাসায় অর্থাৎ, হজরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর প্রতিষ্ঠিত তাঁর নিজের বাড়ির মাদরাসায়। হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. নিজেও লেখক ছিলেন। ফলে সে মাদরাসার উস্তাদদের চিন্তাতেও লেখালেখির প্রতি আনুকূল্য ছিল। এজন্য কখনও বাধা আসেনি। পরবর্তী জীবনে মালিবাগ মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি। মালিবাগ মাদরাসাকে তো সে সময়কার সাহিত্যের প্রজননকেন্দ্র বলা যায়। এখান থেকে বাংলাসাহিত্য চর্চার ও লেখালেখি অনুশীলনের বিশেষ প্রোগ্রাম চালানো হত। উস্তাদদেরও অনেকে লেখক ছিলেন। তাদের মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যেও প্রচুর লেখক গড়ে উঠেছিল। এমন পরিবেশে বাধা তো নয়ই বরং আনুকূল্য পেয়েছি।
➤ ছাত্রজীবনে লেখালেখিতে জড়ালে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে- এমনটা অনেকে বলে থাকেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
এটা বাস্তবসম্মত কথা। বাস্তবেও দেখা যায় অনেক ছাত্র লেখক হতে চায়, এর জন্য অনেক সময় ব্যয় করে, দরসিয়াতের বাইরের বই-পত্র পড়াশোনা করে; কিন্তু তারা মূল যে উদ্দেশ্য দরসি কিতাবে দক্ষ হওয়া, এখানে দুর্বল থাকে। তখন এটা আপত্তিকর হয়েই যায়। কিন্তু কোনো ছাত্র যদি দরসি ইলম যথাযথভাবে পূর্ণ আয়ত্ব করার পর সময়কে কাজে লাগায়, সাহিত্যচর্চা করে, লেখালেখির অনুশীলন করে, তাহলে এর বিরোধিতা কেউ করেন না। যারা বিরোধিতা করেন তারা এজন্যই করেন যে, সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখিতে মন দিয়ে আসল জিনিস থেকে যেন দূরে সরে না যায়। আসলটা ঠিক রেখে অতিরিক্ত দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করার জন্য যদি কেউ চেষ্টা করে তাহলে কোনো উস্তাদ বাধা দেন বলে আমার জানা নেই। দু’একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা কোথাও ঘটতেও পারে।
➤ শৈশবে কাদের লেখা বেশি পড়তেন?
তখন আমি যাদের লেখা সাহিত্য বিষয়ক বইপত্র বেশি পড়েছি তারা হলেন শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, বিমলমিত্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, ফররুখ আহমদ প্রমুখ। এরাই ছিলেন সে সময়কার ফেবারিট সাহিত্যিক।
➤ সাহিত্যচর্চায় বাংলাদেশি ওলামায়ে কেরাম ভারত পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম থেকে পিছিয়ে থাকার কারণগুলো কী?
এক সময় আমাদের অঞ্চল দিল্লী কেন্দ্রিক ছিল। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক ছিল। অর্থাৎ, উর্দূ কেন্দ্রিক ছিল। ফলে বাংলা ভাষাভাষী উলামায়ে কেরামের সাহিত্য অঙ্গনে অগ্রসর হওয়ার আনুকূল্য কম ছিল। তারপর এখন আমাদের কাংখিত অগ্রসর হতে না পারার একটা বড় কারণ হলো, আমাদের অনুবাদপ্রীতি বা অনুবাদনির্ভরতা। একসময় আমাদের দেশে লেখকের সংখ্যা কম ছিল। এখন লেখকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু অধিকাংশই অনুবাদলেখক। অনুবাদে কখনও সাহিত্যের যোগ্যতা আসে না। সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। যখন একজন সৃজনশীল লেখক সৃজনশীল লেখা তৈরি করেন, তখন তার মেধা ও মনন ব্যয় হয়। নিজের থেকে ভাষা ও ভাষার উপস্থাপন তৈরি করতে হয়, ভাব তৈরি করতে হয়। এটা তার সাহিত্য প্রতিভাকে বিকশিত করে। এর বিপরীত যখন সে অনুবাদনির্ভর হয়ে যায় তার মেধা তেমন প্রয়োগ হয় না, তার মনন সেভাবে অগ্রসর হয় না। তার চিন্তাচেতনা সেভাবে অগ্রসর হয় না। অনুবাদনির্ভরতা আমাদের লেখকদের আগে বাড়তে দিচ্ছে না।
আমি অনেক মজলিসে বলে থাকি, আমরা কেন অনুবাদনির্ভর হই। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের যে লেখকদের লেখা আমরা অনুবাদ করি, তাদের চেয়ে আমাদের মেধা তো আলহামদুলিল্লাহ কম নয়। দারুল উলুম দেওবন্দে, দারুল উলুম করাচিতে, নিউটাউনে আমাদের ছেলেরা রেজাল্ট ভালো করে। প্রমাণ হয় আমাদের ছেলেদের মেধা ভালো। কিন্তু আফসোস হল এই মেধাবীরাই ছাত্র পরবর্তী জীবনে তাদের অধস্তনদের বই অনুবাদ করে নিজেদের দৈন্যের পরিচয় দেয়। অনুবাদকে আমি একেবারে বেফায়দা বলছি না, তবে অনুবাদ দ্বারা বাংলাসাহিত্য ততটা সমৃদ্ধ হবে না, যতটা মৌলিক ও সৃজনশীল লেখা দ্বারা হবে। আমরা আমাদের ইসলামী সাহিত্যকে কাঙ্খিত পরিমাণে সমৃদ্ধ করতে পারছি না তার পেছনে বড় একটা কারণ এই অনুবাদনির্ভরতা। আমাদের উলামায়ে কেরামের উচিত মৌলিক ও সৃজনশীল লেখার জন্য উদ্যোগী হওয়া। এতে বাংলা ভাষার ইসলামি সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। উলামায়ে কেরামের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটবে। সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। জাতীয়ভাবেও তা সম্মান বয়ে আনবে। বিদেশিদের বই অনুবাদ করলে আমাদের দেশি লেখকদের সম্মান বাড়বে না, বিদেশি লেখকদের সম্মান বাড়বে। আমাদের উলামায়ে কেরামের সমাজে স্বীকৃতি, সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভের স্বার্থে তাদেরকে মৌলিক রচনায় অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা, রাষ্ট্র পরিচালকরা যখন দেখবে, আমাদের দেশের উলামায়ে কেরাম তো কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, তারা কেবল হিন্দুস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের আলেমরা যা লেখে তা-ই অনুবাদ করে, তাহলে তারা বুঝবে আমাদের দেশের উলামায়ে কেরামের বিদ্যা নেই, মেধা নেই। মেধা ও বিদ্যা সব ওদের। এভাবে আমাদের দেশের উলামায়ে কেরামকে তারা বড় ভাবতে শিখবে না। যখন আমাদের উলামায়ে কেরাম সৃজনশীল লেখা লিখবেন, প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারবেন, তখন তাদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। তখন উলামায়ে কেরামের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে, প্রভাবের সাথে ইসলামের কাজ করা সহজ হবে।
➤ বাংলা সাহিত্যচর্চায় আলেমদের বর্তমান অবস্থানকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আগে লেখক কম ছিল, এখন বেড়েছে। এটা একদিক থেকে আনন্দের। কিন্তু অধিকাংশই অনুবাদনির্ভর, যা খুব একটা আনন্দ দেয় না। তদুপরি দুঃখজনক বিষয় হলো- লেখক অনেক, কিন্তু অধিকাংশই কমার্শিয়াল। তারা পয়সার জন্য লেখে। একজন লেখক যখন পয়সার জন্য লেখে তখন তার লেখা মানসম্পন্ন হয় না। সে তখন চিন্তা করে লেখার পরিমাণ যত বাড়বে আমার পয়সা তত বাড়বে। তখন একটা লেখাকে উত্তরোত্তর সুন্দর করার জন্য যে বারবার পড়তে হয়, বারবার দেখতে হয়, বারবার সংশোধন করতে হয়, এগুলোর জন্য সে অতটা সময় দিতে উদ্বুদ্ধ হয় না। তার মাথায় থাকে যতবেশি লেখা তত বেশি পয়সা। এজন্য লেখা কাংখিত সুন্দর হচ্ছে না। লেখা অনেক আসছে, কিন্তু মানসম্পন্ন ভালো লেখা খুব বেশি একটা আসছে না। এর একটা বড় কারণ হল কমার্শিয়াল চিন্তা। আগের যুগের উলামায়ে কেরাম বই লিখতেন। তাদের কমার্শিয়াল চিন্তা তো দূরের কথা, জীবদ্দশায় বইটি বের হবে এমন চিন্তাও থাকত না। যখন কেউ মৌলিক লেখা লিখবে এবং মাথায় কমার্শিয়াল চিন্তা থাকবে না, বরং চিন্তা থাকবে আমি এটা সুন্দর করব, প্রয়োজনে পাঁচবার-দশবার দেখব, তখন লেখা অনেক সুন্দর হয়ে আসবে। কিন্তু কমার্শিয়াল চিন্তা প্রবল থাকায় তেমনটা হতে পারছে না। মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ সাহেব সম্পর্কে অনেকেই জানেন যে, একটা লেখা তিনি পাঁচবার-দশবার দেখেন। একটা বই দুই মাস-ছয় মাস থেকে এক-দুই বছর পর্যন্ত ফেলে রাখেন। বারবার দেখতে থাকেন, সংশোধন করতে থাকেন। এভাবে তার লেখা সুন্দর হয়।
এই যে রবি ঠাকুর, একজন হিন্দু, যার পরকালে ভাল কিছু পাওয়ার বলে কিছু নেই, তিনিও মুত্যুশয্যায় বসে বসে তার বই কারেকশন করেছেন, সংশোধন করেছেন। যার লেখার বিনিময়ে পরকালে কিছুই পাওয়ার নেই তার লেখা যদি সুন্দর করার চিন্তা থাকতে পারে তাহলে আমরা যারা সবকিছু পরকালের জন্য লিখি আমাদের লেখা আরও নির্ভুল করা যায় কি না, আরও সুন্দর করা যায় কি না, এই চেষ্টা তো সারাজীবনই থাকার কথা। সেখানে শুরুতেই যদি এই চেষ্টা না থাকে তাহলে পরবর্তীতে আর কখন হবে। তাই আমার বক্তব্য হল- লেখা ভাল করতে হলে কমার্শিয়াল চিন্তা থেকে উঠে আসতে হবে। সেই সাথে লেখাকে মানসম্পন্ন করার জন্য যা যা করার দরকার সবই করতে হবে।
➤ আলেমদের গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? বর্তমান বাস্তবতায় আলেমদের মিডিয়া কি সম্ভব?
আলেমদের গণমাধ্যম থাকা অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং এটা সম্ভবও। ইতোমধ্যে আমাদের ফুজালারা দুই-একটা অনলাইন নিউজপোর্টাল পরিচালনা শুরুও করেছে। আলহামদুলিল্লাহ, তারা দক্ষতার পরিচয়ও দিচ্ছে। শুধু অনলাইন মিডিয়া নয়, প্রিন্ট মিডিয়াতেও যদি আমাদের লোকজন কাজ করে, ভালো হবে। অবশ্য সমাজ ধীরে ধীরে অনলাইন মিডিয়ার দিকে বেশি অগ্রসর হচ্ছে। সামনে হয়তো প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর পরিসর আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। যাহোক মিডিয়ার লাইনে আমাদের অগ্রসর হওয়া দরকার।
একটা সময় ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে লেখা হতো, উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে লেখা হতো। উলামায়ে কেরাম প্রতিবাদলিপি দিলে তা ছাপাও হতো না। এখন আমাদের কিছু ছিটেফোটা মিডিয়া থাকায় এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এটা আরও ব্যাপকতর হলে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে, মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রমূলক লেখার পরিমাণ কমে আসবে। তারা চিন্তা করবে যে, এটার কাউন্টার হবে। আমরা তাদের কথা না ছাপলেও তা ছাপার লোক আছে। তখন তাদের অপকর্মের মাত্রা কমে আসবে। তদুপরি ইসলামের সঠিক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও মিডিয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
➤ আপনার বেশ কিছু বই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কেউ আপনাকে অনুসরণ করতে চাইলে কী পরামর্শ দেবেন?
আমার লেখার কিছু মৌলিক নীতিমালা আছে। কিছু মৌলিক চিন্তা নিয়ে আমি কাজ করি। তার মধ্যে প্রধান চিন্তা হলো, যে বিষয়গুলো জাতির প্রয়োজন রয়েছে, উম্মতের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু কেউ কাজ করছে না, আমি এ রকম কাজগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উপর কাজ করি। এরকম মৌলিক ও অনন্য বিষয়সম্পন্ন বই যখন পাঠকদের সামনে আসে তারা দেখে যে, এ বিষয়ে আর কেউ লেখেনি অথচ প্রয়োজনীয়, তখন আমার বইয়ের প্রতি তাদের আকর্ষণ ও ভক্তি বাড়ে, ফলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমাদের আকাবির আসলাফ যেসব বিষয়ে লিখে গেছেন, এক দু’জন লিখেছেন, সেগুলো ভেঙেচুরে ওরকম আরেকটা করলাম- এটা আমি করি না। আরেকটি বিষয় হলো যে বিষয়ে আমি লিখি সে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু অন্তর্ভূক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে বইটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর পূর্ণ সমৃদ্ধ হয়। যেন একটা বই একটা বিষয়ে সার্বিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। সাথে সাথে কীভাবে উপস্থাপন করলে বুঝতে সহজ হবে, আকর্ষণীয় হবে এটাও চিন্তায় রাখি। এভাবেই আমি মাসায়েলের ওপর লিখেছি, ফাজায়েলের ওপর লিখেছি, আকায়েদ ও ফিরাকে বাতিলার ওপর লিখেছি, ভূগোলের ওপর লিখেছি, মনোবিজ্ঞানের ওপর লিখেছি ইত্যাদি। তাই আমার লাইনে আসতে চাইলে মৌলিক রচনার লাইনে আসতে হবে, জাতির প্রয়োজন সামনে রেখে কিছু দেয়ার লাইনে আসতে হবে, চর্বিত-চর্বন নয় বরং সৃজনশীল নতুন কিছু রচনার লাইনে আসতে হবে।
➤ বর্তমানে কী কাজ করছেন? ভবিষ্যতে কী কাজের পরিকল্পনা রয়েছে?
বর্তমানে অতি সম্প্রতি ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কাজ চলছে। ইতিহাসের ওপর তো অনেক বই লেখা হয়েছে, কিন্তু সব ইতিহাসের বইয়ে মৌলিক একটা সমস্যা আছে। লেখা তো অনেক কিছুই থাকে কিন্তু কতটুকু নির্ভরযোগ্য এবং কতটুকু নির্ভরযোগ্য নয়- এই দোদুল্যমানতায় পুরো বই পাঠ করতে হয়। এমন বই প্রচুর লেখা হয়েছে। আমি চিন্তা করলাম, ইতিহাস বিষয়ে এমন একটা বই আসা দরকার, যার পুরোটা নির্ভরযোগ্য হবে। বইটা পাঠ করলে সে যেন এই চিন্তা নিয়ে পাঠ করতে পারে যে, এই বইয়ে যা লেখা হয়েছে সবটা নির্ভরযোগ্য। এর জন্য হজরত আদম আ. থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাসকে আমি দুই ভাগে ভাগ করেছি। এক ভাগ হজরত আদম আ. থেকে আমাদের নবীজি ও সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত। পরবর্তী ভাগে এর পরের ইতিহাস। প্রথম ভাগের বই প্রায় প্রস্তুত হয়ে গেছে, আলহামদুলিল্লাহ। এই অংশে ইতিহাসের কেবল ততটুকু এসেছে যতটুকু কুরআনে বা সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এর নাম দিয়েছি ‘কুরআন ও সহিহ হাদিসে বর্ণিত ইসলামী ইতিহাস’। এতে তথ্যাবলি হয়তো কম থাকবে, কিন্তু যতটুকু থাকবে ততটুকু পূর্ণ নির্ভরতার সাথে গ্রহণ করা যাবে। এর চার খণ্ড ফাইনাল হয়ে গেছে। ৫ম খণ্ডের ফাইনাল দেখা বাকি। সেটাও কিছু দিনের মধ্যে শেষ হবে ইনশা আল্লাহ। পরের ভাগের ইতিহাসে তো কুরআন হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যাবে না, এখানে অন্যান্য ইতিহাসে বর্ণিত তথ্য যাচাইয়ের জন্য কিছু নীতিমালা গ্রহণ করেছি। বিশিষ্ট আলেমদের সাথেও আলাপ করেছি যে, কীভাবে ঐতিহাসিক তথ্যগুলো যাচাই করলে তুলনামূলকভাবে সঠিক ইতিহাস বেশি আসতে পারে। এভাবে এই অংশের কাজ করারও প্রোগ্রাম আছে। তা ছাড়া ভূগোলসংক্রান্ত কিছু বিষয়, কুরআন তরজমা, কুরআন তরজমার উসুল, তাফসীরের উসুল এবং তরজমা ও তাফসীরের জটিল জায়গাসমূহের সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে কিছু কাজ করা আছে, আরও কাজ চলছে। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দিলে এক সময় এগুলোও সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।