লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد:
ইদানিং ওয়ায়েজ ও ধর্মীয় বক্তার সংখ্যা বেড়েছে প্রচুর। বেড়েছে ওয়াজ-মাহফিলের পরিমাণও। ওয়াজ-মাহফিলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া অর্থ দ্বীনের সহীহ শিক্ষার বেশি বিস্তার ঘটা, দ্বীন প্রচারে ব্যাপকতা ঘটা যা মানুষের মধ্যে দ্বীনদারী বৃদ্ধি করার একটা বড় ওছীলা। এ অর্থে ওয়াজ-মাহফিলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া দ্বীনের জন্য একটি ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু কিছু কিছু ওয়াজ-মাহফিলে এখন এমন অনেক কিছু চালু হয়েছে যা দ্বীনদারী বৃদ্ধি করছে না বরং বদ-দ্বীনী বৃদ্ধি করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন ওয়াজের ভিডিও দেখে জানা যাচ্ছে কিছু কিছু ওয়াজে যোগ হয়েছে নানান ধরনের বুলিবচন ও ভাব-ভঙ্গিমা। কিছু কিছু ওয়াজ-মাহফিলে চলছে শ্রোতাদের বিনোদন দেয়ার জন্য গানের সুরে এটা সেটা গাওয়া, এমনকি সরাসরি গান গেয়ে শোনানো, চলছে নাটুকেপনা ও নানান রকম ভাড়ামো। কিছু কিছু মাহফিলে চলছে যিকিরের নামে নর্তন-কুর্দন। কিছু কিছু ওয়াজ-মাহফিলে ওয়াজ তো নয় চলছে বিভিন্ন জনকে গালিগালাজ এবং বিভিন্ন জনের অযাচিত সমালোচনা ও খিস্তিখেউড়। কিছু কিছু ওয়াজ-মাহফিলে আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য আমদানি করা হচ্ছে ক্ষুদে বক্তা, শিশু বক্তা, হিজড়া বক্তা, কমেডিয়ান বক্তা এমনকি নারী বক্তা পর্যন্ত। এভাবে ওয়াজ-মাহফিলের মত একটা ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ দ্বীনী অনুষ্ঠানকে রঙ্গ-রস ও খেল-তামাশার আসরে পরিণত করা হচ্ছে। বিনোদনের আসরে পরিণত করা হচ্ছে। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক! এটা দ্বীনী কাজে বিকৃতি সাধন হেতু নি:সন্দেহে মারাত্মক অপরাধ। এমনতর মাহফিল থেকে হেদায়েতের আলো ছড়াবে না, ঈমান আমলের চেতনা ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক মিল মহব্বত, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদির কথা ছড়াবে না। বরং গোমরাহির অন্ধকার ছড়াবে, ঈমান-আকীদা বিধ্বংসী চেতনা ছড়াবে, গলত আমলের বার্তা ছড়াবে, মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বদ-আখলাকী ছড়াবে। দুঃখজনক হলেও সত্য এ জাতীয় অনুষ্ঠানের কল্যাণে (?) ইতিমধ্যে কিছু পরিসরে তেমনটা শুরু হয়েও গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যা কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। তাই আবারও বলছি, নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক!
ওয়াজ মাহফিলের এই বিকৃতির জন্য কারা দায়ী? এর জন্য যেমন ঐসব ওয়াজ -মাহফিলের সংশ্লিষ্ট বক্তারা দায়ী, তেমনি দায়ী ঐসব মাহফিলের আয়োজক উদ্যোক্তারাও। বক্তারা দায়ী এ কারণে যে, তারা আসছেন ওয়াজ ও নসীহতের জন্য, অথচ “ওয়াজ” ও “নসীহত” বলতে কী বুঝায় তা বিস্মৃত হয়ে তারা অন্য অনেক কিছুতে লিপ্ত হচ্ছেন। অনেকের হাবভাব দেখে মনে হয় তারা ওয়াজ করতে আসেন না বরং আসেন মানুষকে বিনোদন দিতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে এবং এভাবে নাম কামাই করে ভবিষ্যতে মোটা অংকের ধান্ধা করার লাইন রচনা করতে। নতুবা দ্বীন যদি তাদের মাকসাদ থাকবে তাহলে ওয়াজের নামে এসব কেন? চেহারা দেখানো, কণ্ঠ শোনানো ও বাচনভঙ্গি ফলানো নিয়ে এত কসরত কেন? ছবি ভিডিও নিয়ে এত তোড়জোড় ও ব্যস্ততা কেন? যাহোক এসব কারণে বক্তারা দায়ী। আর আয়োজক উদ্যোক্তারা দায়ী এ কারণে যে, তারা ওয়ায়েজ বা বক্তা নির্বাচন করার সময় কাদের দ্বারা প্রকৃত ওয়াজ-নসীহত হবে, ওয়াজ-নসীহতের জন্য কোন্ ধরনের বক্তা নির্বাচন করা চাই, কোন্ ধরনের বক্তার ওয়াজ-নসীহত শোনা চাই- এসব কথা মাথায় না রেখে অন্য অনেক ধরনের অবাঞ্ছিত চিন্তা মাথায় রেখে ওয়ায়েজ বা বক্তা নির্বাচন করছেন। যেমন তারা মাথায় রাখছেন কার সুর ভাল তাকে আনতে হবে যেন শ্রোতারা মুগ্ধ হয়। তারা মাথায় রাখছেন কে সেলিব্রেটি তথা নামকরা তাকে আনতে হবে যেন লোক সমাগম বেশি হয়। তারা মাথায় রাখছেন কে হাসাতে পারে তাকে আনতে হবে যাতে শ্রোতারা মজা পায়। তারা মাথায় রাখছেন ব্যতিক্রম ধরনের কোন বক্তা আনতে হবে যাতে বৈচিত্র সৃষ্টি হয়। তা বৈচিত্র সৃষ্টি করার জন্য ক্ষুদে বক্তা বা শিশু বক্তা কিংবা হিজড়া বক্তা বা কোন কমেডিয়ান কিংবা অমুক তমুক শ্রেণীর যাকে হোক আনতে হবে। আয়োজক ও উদ্যোক্তারা এসব নামী দামী, কোকিলকণ্ঠী, হাসানো কাঁদানো ও বিচিত্র ধরনের বক্তা আনার চিন্তা এজন্যও করে থাকেন যাতে লোক সমাগম বেশি হয়, এটাকে কেন্দ্র করে কালেকশনও ভাল হয় এবং সর্বোপরি তাদের নামডাক হয়। কার দ্বারা হেদায়েত ভাল হবে, কার দ্বারা সত্যিকারের নসীহত হবে- এ চিন্তা তারা মাথায় কম রাখেন। এ চিন্তাই যদি তাদের মাথায় থাকবে তাহলে তো খোদাভীরু মুত্তাকী পরহেযগার হক্কানী আলেমদেরকেই বক্তা হিসেবে নির্বাচন করার কথা।
এভাবে বক্তা নির্বাচনে আয়োজক উদ্যোক্তাদের ভুলনীতি সেই সাথে বক্তাদের অনাকাঙ্খিত বক্তব্য, বুলিবচন ও আচরণ সবকিছু মিলিয়ে দ্বীনী মাহফিলগুলোর কাঙ্খিত ফায়দা হারিয়ে যাচ্ছে। দ্বীনী মাহফিলগুলো বদ দ্বীনী আসরে পরিণত হচ্ছে। হেদায়েতের মজলিস খেল-তামাশা ও রঙ্গ-রসের মজলিসে পরিণত হচ্ছে। দ্বীনী মাহফিলে ঘটছে বিকৃতি। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক! আফসোস শত আফসোস! এটা যে দ্বীনের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তা কি ভেবে দেখা উচিত নয়? সংশ্লিষ্ট সকলকে ভেবে দেখার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আয়োজক উদ্যোক্তাদের সতর্ক থাকা চাই তারা যেন ওয়াজ-মাহফিলের নামে ছওয়াব কামাই করতে গিয়ে গোনাহ কামাই করে না বসেন। আয়োজক উদ্যোক্তাদের মনে রাখা চাই ওয়াজ-মাহফিল রঙ্গ-রসের জন্য নয়, ওয়াজ-মাহফিল বিনোদনের জন্য নয়, ওয়াজ-মাহফিল শ্রোতাদের কান সুখ করানোর জন্য নয়, ওয়াজ-মাহফিল টাকা-পয়সা কালেকশনের জন্য নয়। এগুলো ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য নয়। ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য ওয়াজ ও নসীহত-এর মাধ্যমে মানুষের হেদায়েত। ওয়াজ-মাহফিল ওয়াজ ও নসীহতের জন্য।
বস্তুত ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য এবং ‘ওয়াজ’ ও ‘নসীহত’ বলতে কী বুঝায় তা যদি বক্তাগণ ও বক্তা নির্বাচনকারীগণ মাথায় রেখে কাজ করেন তাহলেই ওয়াজ মাহফিলগুলোর এই বিকৃতি থেকে উত্তরণ সম্ভব এবং এভাবেই ওয়াজ মাহফিলগুলোকে সত্যিকার অর্থে কল্যাণময়ী করে তোলা সম্ভব।
তাই আমি এখানে ‘ওয়াজ’ ও ‘নসীহত’ বলতে কী বুঝায় অর্থাৎ কথা দু’টোর কী অর্থ ও ব্যাখ্যা তা বর্ণনা করছি। আশা করি তাতে ওয়াজ-মাহফিলের বক্তাদের কী কী ধরনের কথা বলা উচিত তা সামনে এসে যাবে। তারা যদি সেভাবে বক্তব্য প্রদান করেন আর সে ধরনের বক্তব্য যাদের দ্বারা হবে তাদেরকেই যদি আয়োজক ও উদ্যোক্তারা বক্তা হিসেবে নির্বাচন করেন তাহলেই ওয়াজ মাহফিলগুলো সত্যিকার অর্থে কল্যাণ বয়ে আনবে।
“ওয়াজ”-এর অর্থ
কুরআনে কারীমে ‘ওয়াজ’ ধাতুমূল থেকে উদগত শব্দ এসেছে ৩টি আয়াতে। যথা: সূরা নিছা-এর ৬৩ নং আয়াতে, সূরা লুকমান-এর ১৩ নং আয়াতে ও সূরা সাবা-এর ৪৬ নং আয়াতে। হাদীছেও শব্দটি এসেছে। নিম্নে বিশিষ্ট অভিধান, তাফসীরের কিতাব ও হাদীছের শরাহ-গ্রন্থাদি থেকে ওয়াজ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে তার কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি।
* الوعظ : النصح والتذكير بالعواقب. (الصحاح في اللغة)
* وَعظَه: ذكّره ما يلين قلبَه من الثواب والعقاب. (تاج العروس)
* إن الوعظ بيان ما يصلح به حال من يوعظ. (روح المعاني)
* الوعظ كلام يلين القلب بذكر الوعد والوعيد. (تفسير البغوي)
* قال العيني: وهو التذكير بالعواقب. (عمدة القاري)
উলামায়ে কেরাম আরবী ইবারতগুলোর অর্থ বুঝবেন। সাধারণ মানুষ যারা বুঝবেন না তাদের জন্য বলছি, বিশিষ্ট অভিধান-গ্রন্থ আস-সিহাহ ও তাজুল আরূছ, বিশিষ্ট তাফসীর-গ্রন্থ রূহুল মাআনী ও তাফসীরুল বাগাবী এবং বিশিষ্ট হাদীছের শরাহ-গ্রন্থ উমদাতুল কারী-র বরাতে পেশকৃত উপরোক্ত ইবারতসমূহে যা বলা হয়েছে তার সারকথা হল- ‘ওয়াজ’ বলতে বুঝায় এমন সব কথা যা দ্বারা মানুষের (ঈমান-আকীদা, ধ্যান-ধারণা ও আমল আখলাকের) সংশোধন হয়। ওয়াজ বলতে বুঝায় বিভিন্ন নেক আমলের ছওয়াব ও পুরষ্কার কি এবং বদ আমলের শাস্তি ও খারাপ পরিণাম কি সেগুলো বর্ণনা করা যাতে মানুষের দিল নরম হয়।
“নসীহত”-এর অর্থ
কুরআনে কারীমে নসীহত-এর ধাতুমূল থেকে উদগত বিভিন্ন শব্দ এসেছে বহু আয়াতে। যথা: সূরা হূদ-এর ৩৪ ও ৬৮ নং আয়াতে, সূরা আ’রাফ-এর ২১ ও ৭৯ নং আয়াতে ও সূরা ক্বাসাস-এর ২০ নং আয়াতে। হাদীছেও নসীহত শব্দটি এসেছে। নিম্নে বিশিষ্ট অভিধান, তাফসীরের কিতাব ও হাদীছের শরাহ-গ্রন্থাদি থেকে নসীহত শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে তার কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি।
* نصح : خلص والثوبَ : خاطه. (القاموس المحيط)
* النصح تصفية العسل وخياطة الثوب. (تاج العروس)
* نصح الشيئ خلص والناصح الخالص من العسل. (لسان العرب)
* النصح في اللغة الخلوص يقال : نصحت العسل إذا خلصته من الشمع ويقال: هو مأخوذ من نصح الرجل ثوبه إذا خاطه. (روح المعاني)
* قال الخطابي: النَّصِيحَة كلمة جامعة معناها حيازة الحظ للمنصوح له. (شرح مسلم للنووي)
* قال العيني : وأصل النصيحة مأخوذ من نصح الرجل ثوبَه إذا خاطه بالمنصحة وهي الإبرة والمعنى أنه يلم شعث أخيه بالنصح كما تلم المنصحة. (عمدة القاري)
* والمعنى أنه يلم شعث أخيه بالنصح كما تلم المنصحة. (فتح الباري)
উলামায়ে কেরাম আরবী ইবারতগুলোর অর্থ বুঝবেন। সাধারণ মানুষ যারা বুঝবেন না তাদের জন্য বলছি, বিশিষ্ট অভিধান-গ্রন্থ আল-কামূছুল মুহীত, তাজুল আরূছ ও লিসানুল আরব, বিশিষ্ট তাফসীর-গ্রন্থ রূহুল মাআনী এবং বিশিষ্ট হাদীছের শরাহ-গ্রন্থ শরহে নববী, উমদাতুল কারী ও ফাতহুল বারী-র বরাতে পেশকৃত উপরোক্ত ইবারতসমূহে যা বলা হয়েছে তার সারকথা হল- ‘নসীহত’ বলতে বুঝায় এমন সব কথা যা দ্বারা মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধন হয় এবং মানুষের জীবন বিশুদ্ধ ও পূতপবিত্র হয়।
অতএব যাদের দ্বারা এই ওয়াজ- নসীহত হবে না তাদেরকে ওয়াজ-মাহফিলের বক্তা বানানো থেকে বিরত থাকা চাই। যারা ওয়াজ- মাহফিলকে খেল-তামাশা ও রঙ্গ-রসের মজলিসে পরিণত করছে, যারা ওয়াজ-মাহফিলের দ্বীনী রূপে বিকৃতি ঘটাচ্ছে, তাদেরকে সর্বতোভাবে বর্জন করা চাই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার ও মানার তাওফীক দান করুন। আমীন!
وما عليناإلا البلاغ