You are currently viewing উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (৯)

উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (৯)

মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

সমরকন্দ

          আধুনিক উজবেকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনবহুল শহর হলো সমরকন্দ। তৈমুর লং এ শহরকে তার বিশাল রাজত্বের রাজধানী করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২০০০ সালে এই নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। পুরোনো শহরটি আফরোসিয়াব নামে পরিচিত। গ্রিকরা সমরকন্দকে বলে মারাকান্দা।

 

          সমরকন্দ শহরের নাম গঠিত হয়েছে দুই ভাষার দুটো শব্দ থেকে। প্রাচীন ফার্সী ভাষার আসমারা শব্দ (যার অর্থ পাথর) এবং সোজিয়ান ভাষার কন্দ শব্দ (যার অর্থ দূর্গ বা শহর) থেকে। সব মিলিয়ে সমরকন্দ-এর অর্থ দাঁড়ায় পাথরের দূর্গ বা পাথরের শহর।

          খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকের শুরুর দিকে শরহটি আরবের মুসলিম শাসকদের অধিকারে আসে। ফলে এখানে ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুনের বিকাশ ঘটে এবং কালক্রমে মধ্য এশিয়ার একটি ইসলামিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

          ১২২০ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিজ খান শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুর লং সমরকন্দকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী বানান। এই সময়ে শহরটির আবার উন্নতি শুরু হয়। 

 

সমরকন্দ গমন

          ২৮//২৪ রোজ রবিবার সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে বুলেট ট্রেনে রওয়ানা দিয়ে দুই ঘন্টা দশ মিনিটে আমরা তাশখন্দ থেকে সমরকন্দ পৌঁছি। ট্রেন পথে তাশখন্দ থেকে সমরকন্দের দূরত্ব ৩০৭ কিলোমিটার। ট্রেন ভাড়া মাথাপিছু ২৪৫০০০সোম তথা ২৩৭৮ টাকা।

          উজবেকিস্তানের বুলেট ট্রেন মানসম্পন্ন এবং দ্রুতগামী ট্রেন। যাত্রার কয়েকদিন আগেই টিকেট কেটে না রাখলে যাত্রার মুহূর্তে বা যাত্রার কিছু আগে টিকেট পাওয়া যায় না। আমরা উজবেকিস্তান পৌঁছার কয়েকদিন আগেই মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব আমাদের জন্য তাশখন্দ থেকে সমরকন্দ, সমরকন্দ থেকে বুখারা ও বুখারা থেকে তাশখন্দের টিকেট করে রেখেছিলেন।

 

          সমরকন্দ ট্রেন স্টেশনে নামার পর আমাদের রিসিভ করেন মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব কর্তৃক নির্বাচিত জামেয়া আযহারের ছাত্র মাওলানা আব্দুল হাই আল-হালওয়ায়ী ও তার সঙ্গী সমরকন্দের এক স্কুলের পরিচালক জনাব শওকত সাহেব। তারা আমাদের সমরকন্দের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখান।

          সমরকন্দে বুলওয়ার গার্ডেন (যার পাশে চৌরাস্তায় তৈমুর লং-এর ভাস্কর্য রয়েছে।)-এর পাশে কোক সারয় প্লাজায় আমাদের থাকা হয়। এলাকার নামও কোক সারয়। এখানে থাকার সুবিধে হল এখান থেকে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান খুব কাছে। পায়ে হেঁটেও সে স্থানগুলোতে যাওয়া যায়। যেমন রেগিস্তান, বিবি খানম, গোর আমীর (আমীর তৈমুর লং-এর সমাধিসৌধ) প্রভৃতি।

 

সমরকন্দে যা যা দেখলাম

গোর আমীর

          মাওলানা আব্দুল হাই আল-হালওয়ায়ী, জনাব গায়রত সাহেব ও জনাব শওকত সাহেব তাদের দুটো প্রাইভেট গাড়িতে আমাদেরকে নিয়ে গেলেন গোর আমীরে। অর্থাৎ আমীর তৈমুর লংএর কবরে। আমাদের হোটেল থেকে সামান্য দূরেই ছিল গোর আমীর। এমনিতেও সমরকন্দে ভাড়ার গাড়িতে যেকোনো স্থান থেকে গোর আমীরবললে আমীর তৈমুর লং-এর কবরে নিয়ে যায়। গোর শব্দের অর্থ কবর। তাই গোর আমীর অর্থ আমীরের কবর অর্থাৎ আমীর তৈমুরের কবর। থেকে মহল্লার নামও হয়েছে গোর আমীর। অনেকে উচ্চারণ করে কোর আমীরইংরেজিতে লেখে গুর-ই-আমির (Gur-i-Amir)ফার্সী ভাষার বিশুদ্ধ নিয়মানুযায়ী উচ্চারণ হওয়া চাইগোরে আমীর

 

          ভেতরদিকে সোনা দিয়ে কারুকার্য করা একটা বড় উঁচু শানদার ইমারত (Mausoleum/সমাধিসৌধ)-এর মধ্যে আমীর তৈমুর ও তার আধ্যাত্মিক উস্তাদ মীর সাইয়্যেদ বরকত-এর কবর। পাশে আরও কিছু কবরও রয়েছে। মাঝের দিকে সাদা পাথরে মোড়ানো কবরটি মীর সাইয়্যেদ বরকত-এর কবর। তার পায়ের কাছে কালো পাথরে মোড়ানো কবরটি আমীর তৈমুরের কবর। আমাদের গাইড মাওলানা আব্দুল হাই আল-হালওয়ায়ী জানালেন, মৃত্যুর পূর্বে আমীর তৈমুর ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন তাকে যেন উস্তাদের পায়ের কাছে সমাহিত করা হয়।

 

শাহ-ই-জিন্দা

          শাহ-ই-জিন্দা হচ্ছে সমরকন্দের উত্তর পূর্ব দিকের একটি গোরস্থান (Necropolis)বলা যায় সমাধি কমপ্লেক্স। আমাদের দেশে গোরস্তান বা কবরস্তান বললে যেরকম চিত্র মনে ভাসে যে, সমতল স্থানে খালি খালি অনেক কবর বা দুই চারটা সামান্য উঁচু করে বাঁধানো কবর। এ কবরস্তানটি সেরকম নয়। এখানে রয়েছে অনেক সমাধিসৌধ, যেগুলোর মধ্যে কবর। অনেক সমাধিসৌধের ছাদ আবার মসজিদের মত গম্বুজবিশিষ্ট। অজানা লোকেরা প্রথম দেখলে মনে করবে বুঝি কোন মসজিদ কমপ্লেক্স হবে।

          এই শাহ-ই-জিন্দা গোরস্তানে রয়েছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হযরত আব্বাস রা.-এর পুত্র হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস (قثم بن عباس) রা.-এর কবর।

          শাহ-ই-জিন্দা হচ্ছে সমরকন্দের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে একটি।

          ‘শাহ-ই-জিন্দাকে উজবেক উচ্চারণে বলা হয় শোহিজিন্দা। শব্দটি মূলত ফার্সী: شاه زنده (শাহে জিন্দা)। যার অর্থজীবন্ত রাজাএই শাহে জিন্দা বা জীবন্ত রাজা বলে হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস রা.কেই বোঝানো হয়।

          হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস রা. ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অবয়বে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ। সমরকন্দ বিজয়ের অভিযানে তিনি শরীক ছিলেন। এখানেই ৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং এখানেই তাকে দাফন করা হয়।

 

          হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস রা.-এর কবর পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গাতে। মাটির স্তর থেকে অনেকগুলো সিড়ি বেয়ে একেবারে উপরে উঠে ডান দিকে একটি সমাধিসৌধের মধ্যে তার কবর। উপরে উঠার যে সিড়িগুলো, তার দুই পাশে রয়েছে বহু সমাধিসৌধ। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আমীর তৈমুর লং-এর সেনাপতি, আমীর তৈমুর লং-এর বোন, তার পুত্র, তার আপনজন ও আত্মীয় স্বজনের কবর। আরও অনেকের কবর।

 

          হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস রা.-এর কবর যে রুমের মধ্যে তার পাশের রুমে থেকে কবরটি যিয়ারত করা হয়। জানালা দিয়ে পরের রুমে থাকা কবরটি দেখা যায়- এ অবস্থায় যিয়ারত করা হয়। মূল রুমটি -যে রুমে কবর- তালাবদ্ধ থাকে। কবরটির দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ছিলেন আমাদের মেজবান মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবের ছাত্র। আর আমরা ছিলাম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবেরই মেহমান। এই সুবাদে আমাদেরকে মূল রুমে প্রবেশ করে একেবারে কবরের কাছে গিয়ে যিয়ারতের সুযোগ করে দেওয়া হয়। যিয়ারতের পর যে রুমে থেকে সাধারণত যিয়ারত করা হয় -যা পূর্বে বলা হল-, সেই রুমের সামনের দিকের ডান পাশে একটা ছোট্ট দরজা রয়েছে, সেই দরজা খুলে আমাদেরকে ভূগর্ভস্থ একটা গুহায় নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয় হযরত কুছাম ইবনে আব্বাস রা. এই গুহায় নির্জনে ইবাদত করতেন।

 

Leave a Reply