মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
ইমাম কাফফাল শাশী-এর মাজার
তাশখন্দে যা কিছু দেখা হয়েছে তার মধ্যে আর একটি হল ইমাম কাফফাল শাশী রহ.-এর
মাজার। ইমাম কাফফাল শাশী হলেন আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে ইসমাঈল। তাকে বলা
হয় কাফফাল কাবীর (القفال الكبير)। কাফফাল শব্দের অর্থ তালাওয়ালা। তার জীবনের
প্রথম দিকে তালা তৈরির পেশা ছিল। তালা তৈরির কাজে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। এ জন্য
তার উপাধি হয়ে দাঁড়ায় কাফফাল।
কাফফাল শাশী রহ. শাফিঈ মাযহাবের একজন বড় ব্যক্তিত্ব। তাকে ইমাম আবূ জাফর
তাহাবীর সমপর্যায়ের ব্যক্তি মনে করা হয়। তার যুগে তাকেই মাওয়ারাউন্নাহার এলাকার
ইমাম ও সবচেয়ে বড় আলেম গণ্য করা হত। তিনি একাধারে ফকীহ, মুফাসসির, আভিধানিক
ও উসূলে ফিকহের বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি হাদীছের একজন রাবী (বর্ণনাকারী)। আবূ
বকর ইবনে খুযায়মা, ইবনে জারীর তাবারী, আব্দুল্লাহ
ইবনে ইসহাক মাদাইনী, আবুল কাসেম আল-বাগাবী প্রমুখ থেকে তিনি
রেওয়ায়েত বয়ান করেছেন। তার রচিত অনেক কিতাবও রয়েছে। ৩৬৫ হিজরিতে
শাশ এলাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
কাফফাল শাশী রহ.-এর কবরের পাশে রয়েছে ঈশান বাবা খান ও তার পুত্র জিয়াউদ্দিন
খান-এর কবর। এই ঈশান বাবা খান ছিলেন মধ্য এশিয়ায় দ্বীন প্রচার, ফতোয়া
প্রদান ও দ্বীনী শিক্ষাদানের জন্য গঠিত ‘আল-ইদারাতুদ্দীনিয়্যা (الإدارة الدينية)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বুখারার ঐতিহাসিক
মাদ্রাসা ‘মীর আরব‘-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন
মধ্য এশিয়া ও কাজাখিস্তানের স্বনামধন্য মুফতী। কাফফাল শাশী রহ.-এর কবরের পাশে তার
দুই পুত্র এবং আরও অনেক উলামায়ে কেরামের কবর রয়েছে।
মাজার এরিয়ায় ঢোকার সময় ডান হাতে একটি মাকতাবা (লাইব্রেরি) রয়েছে। এটি
আমাদের গাইড মাওলানা জালালুদ্দীন সাহেবের। এতে আরবী উর্দূ কিতাবই বেশি। এবং
উলামায়ে দেওবন্দের লেখা কিতাবপত্রই বেশি।
মাজার এরিয়ার পাশে আল-মা‘হাদুল ইসলামী (المعهد الاسلامي) নামক একটি মাদরাসা রয়েছে। এটি প্রায়
পঞ্চাশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। এটি কোন ঐতিহাসিক মাদরাসা নয়।
মোয়ী মোবারক মাদরাসা ও জাদুঘর
মোয়ী মোবারক মাদরাসা তাশখন্দের একটি ঐতিহাসিক
মাদরাসা। অন্য অনেক মাদরাসার মতো এটিও বন্ধ আছে। ভিতরে বিভিন্ন মালামালের দোকান
বসানো হয়েছে। গাইড মাওলানা জালালুদ্দীন সাহেব জানালেন এগুলো আগে ছিল না। ইদানিং
বসানো হয়েছে।
মোয়ী মোবারক শব্দটি ফার্সী (موئے مبارك)। শব্দটির বিশুদ্ধ উচ্চারণ ‘মূয়ে
মোবারক’ উজবেক উচ্চারণ মোয়ী মোবারক। অর্থ মোবারক চুল তথা বরকতম
চুল। একসময় এখানে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুল মোবারক ছিল বিধায়
এই নামকরণ। এমনটিই কথিত আছে।
পাশে একটি জাদুঘর আছে। প্রবেশ করতে টিকেট নিতে হয়। গাইড মাওলানা জালালুদ্দীন
সাহেব টিকেট কাউন্টারে আমাদের পরিচয় বড় করে তুলে ধরায় বিনা টিকেটেই খুব
সম্মানের সাথে আমাদেরকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই জাদুঘরটির বিশেষ আকর্ষণ হল- এখানে একটি মুসহাফে
উছমানী রয়েছে। অর্থাৎ হযরত উছমান রা. কুরআন সংকলনপূর্বক কুরআনের যে কয়টি কপি তৈরি করেছিলেন এবং তখনকার বড় বড় মুসলিম শহরে প্রেরণ করেছিলেন এটি সেগুলোরই একটি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে লেখা এ মুসহাফটি খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে আমীর তৈমুর লং
সমরকন্দে এনেছিলেন। বেশ বড় সাইজের মোটা কাগজে লেখা। কাগজের রং অনেকটা লালচে হয়ে
আছে। পাশের দিকে কালচে। হয়তো শত শত বছর পার হওয়ায় ধীরে ধীরে এমন রং ধারণ করেছে।
মুসহাফটির পাশে ইংরেজিতে লিখিত একটি মুসহাফ পরিচিতি বোর্ড রয়েছে। তার বর্ণনা
মোতাবেক ইরাকের বসরা শহর থেকে আমীর তৈমুর লং এটি সমরকন্দে আনেন। রাশিয়ানরা
উজবেকিস্তান দখলের পর এটি সেন্ট পিটার্সবার্গে (রাশিয়ার ২য় বৃহত্তম শহর) নিয়ে
যায়। সেখান থেকে তাতারীদের হাতে চলে যায়। ১৯৭৪ সালে
মামলা-মোকদ্দমা করে আবার এটিকে সমরকন্দে আনা হয়।
মুসহাফটির পেজ সাইজ- ৫৩×৬৮। টেক্সট প্যারামিটার- ৩৩×৩৯, ৩৬×৪৬। পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৩৩৮।
আমরা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে
মুসহাফটির বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম, কিন্তু বের হওয়ার সময় ওরা আমাদের মোবাইলের গ্যালারি চেক
করে সব ডিলিট করে দেয়। বলে, আমরা দুঃখিত, এটা নিষেধ। বাইরে যাওয়ার পর আবার কয়েকজন ছুটে এসে মোবাইল
দেখতে চাইল। বুঝলাম এদেরও উদ্দেশ্য মোবাইলের গ্যালারি চেক করে ঐই মুসহাফের ছবি
ডিলিট করা। আমি তাদেরকে মোবাইল না দিয়েই বললাম, Already Deleted. তখন তারা হেসে দিয়ে আমাদের পথ ছেড়ে দিল। মাওলানা মতিউর
রহমান সাহেবের মোবাইলে কোনোভাবে একটি ছবি রয়ে গিয়েছিল। সেটিই সম্বল রয়ে গেল।
ছবিতে সেটিই প্রদর্শন করা হয়েছে।