You are currently viewing উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (৫)

উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (৫)

মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

উজবেকদের আচার-ব্যবহার ও আতিথেয়তা
উজবেকিস্তান সফরে যাওয়ার আগে উজবেকিস্তান ভ্রমণ সংক্রান্ত অনলাইনের কিছু ব্লগ ও ভিডিও থেকে উজবেকদের আচার-ব্যবহার ও আতিথেয়তা সম্বন্ধে জেনেছিলাম। সকলেই তাদের আচার ব্যবহার ও আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাস্তবেও তা-ই। এক কথায় উজবেকদের আচার-ব্যবহার, নম্রতা ভদ্রতা অতুলনীয়। তাদের কোমল ব্যবহার অবশ্যই আপনাকে মুগ্ধ করবে। খুব সহজেই তারা আপনাকে জয় করে নিবে। বিদেশী পর্যটকদের সাথে তাদের প্রত্যেকের আচরণ আপনজনের মতো আচরণ। বরং তার চেয়েও অধিক। উদার আচরণ, আন্তরিক আচরণ, বিনয়ী আচরণ। আমরা তাশখন্দে একটা মানসম্পন্ন হোটেলে ছিলাম। বিশাল হোটেল। যখন আমরা হোটেল থেকে বিদায় নেই স্বয়ং মালিক আমার লাগেজ বহন করে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। আমাদের দেশে এর কল্পনাও করা যায় কি? তাই যারা উজবেকিস্তান ভ্রমণে যাবেন, সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে অবাধে মিশতে পারবেন। মিশবেন। আনন্দ পাবেন।

উজবেকিস্তানের মানুষ অতিথিপরায়ণ মানুষ। তবে উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আইনে বিদেশী পর্যটকদের বাসা বাড়িতে রাখা নিষেধ। তাই সব পর্যটককেই হোটেল বা গেস্টহাউজেই থাকতে হয়। আমরা যাওয়ার আগেই আমাদের মেজবান মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব আমাদের দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন যে, আমার অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, কিন্তু রাষ্ট্রের আইনে নিষেধ থাকায় আপনাদের ঘরে রেখে আপ্যায়ন করতে পারব না। তবে অনেক ওয়াক্তেই তিনি বা তার লোকেরা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেভাবে আমাদের আপ্যায়ন করিয়েছেন, তাতে উজবেকদের আতিথেয়তার যথেষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। তাশখন্দ, বুখারা, সমরকন্দ সব জায়গাতেই তারা বেছে বেছে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোতেই আমাদের নিয়ে যেত। খাদ্য-খাবার এতো পরিমাণ অর্ডার করত, তৃপ্তি ভরে খাওয়ার পরও বিপুল পরিমাণ রয়ে যেত। প্রায়শই একটা বড় খাঞ্চায় খাবার পরিবেশন করা হত। সকলেই সেটা থেকে নিয়ে নিয়ে খাওয়া হত। সবশেষে যা রয়ে যেত, হোটেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো প্যাকেটে ভরে দিত। যা তারা বাসায় নিয়ে যেত। একদিন আমি জিজ্ঞেস করায় তারা বলেছিল, আমরা উজবেকরা কোন খাবার নষ্ট করি না। খাওয়ার পর যেগুলো রয়ে যায় আমরা বাসায় নিয়ে যাই, বাসার লোকেরা সেগুলো খায়। সত্যিই অনুকরণ করার মতো একটা আদর্শ। আমাদের দেশের নামী দামী রেস্টুরেন্টগুলোতে কী আপচয়টাই না হয়! নিশ্চয়ই অপচয় বে-বরকতির কারণ ঘটে।

উজবেকদের আতিথেয়তার আর একটা ছোট্ট ঘটনা যা আমাদের সাথে ঘটেছে। আমরা সমরকন্দ থেকে তিরমীয গিয়েছিলাম প্রাইভেটকার যোগে। সমরকন্দের পর ক্বাশক্বাদারিয়া প্রদেশ। তারপর সুরখসানদারিয়া প্রদেশ। সুরখসানদারিয়ার শেষ প্রান্তে (দক্ষিণ প্রান্তে) তিরমীয। ফেরার পথে ক্বাশক্বাদারিয়া এলাকায় এক মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। নামাযের পর আশেপাশে কোন চায়ের দোকান আছে কি না খুঁজছিলাম। মসজিদের ইমাম সাহেব টের পেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলেন। আমাদেরকে তার বাড়িতে চা খাওয়ার আবেদন জানালেন। এতে দেরি হবে চিন্তা করে আমরা অস্বীকৃতি জানালাম। তিনি বললেন, গাড়িতে আমার বাড়ি পৌঁছতে মাত্র দুই মিনিট লাগবে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপনাদের ছেড়ে দিতে পারব। তবুও আমি অস্বীকৃতি জানালাম। পাছে আবার দেরি হয়ে যায়। তাহলে সমরকন্দ পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। কিন্তু ইমাম সাহেব নাছোড়। কোনোভাবেই আমরা তাকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না। অগত্যা রাজি হলাম। ইমাম সাহেবের নিজস্ব গাড়ি ছিল। তিনি তার গাড়িতে আগে আগে চললেন। আমরা আমাদের গাড়িতে তার অনুসরণ করলাম। বাড়ি কাছেই ছিল। বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম তার আনুমানিক আট বছর বয়সী এক পুত্র সুরাহির মতো একটা বদনা হাতে বারান্দার সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের হাত ধোয়ানোর জন্য। সফর গাইডদের থেকে জানতে পারলাম এ দেশে এটাই ঐতিহ্য- মেহমান ঘরে ওঠার আগেই তার হাত ধোয়ানো হয়, যাতে ঘরে প্রবেশ করেই সাথে সাথে খাবার গ্রহণ করতে পারে। এটা যে আসলেই এই দেশের একটা ঐতিহ্যবাহী রীতি তার একটা প্রমাণ পেয়েছিলাম বুখারার এক ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টে। বুখারার মূল শহর থেকে পনের ষোল কিলোমিটার দূরে রেস্টুরেন্টটি। মাছের জন্য প্রসিদ্ধ রেস্টুরেন্ট। মাছ পাওয়া যায় শুনেই সেখানে আমরা গিয়েছিলাম। সেখানে প্রবেশ পথেই দেখলাম একটা ভাস্কর্য, যার হাতে ঐই পানির বদনা। যাহোক হাত ধোয়ার পর উঠোনের একটা গাছের তলে নিচে তোষক ও চতুর্দিকে বালিশ লাগানো একটা রেলিং বিশিষ্ট বিশাল খাটে আমরা গোল হয়ে বসলাম। মুহূর্তের মধ্যেই চা চলে এলো। শুধু কি চা। বহু রকমের তাজা ফ্রুট, বহু রকমের ড্রাই ফ্রুট, বহু রকমের রুটি ও মিষ্টি মিঠাই। এতো দ্রুত এতো রকমের খাবার কীভাবে রেডি করা হল জানি না। বুঝলাম আতিথেয়তার জন্য বোধ হয় তারা সর্বদাই প্রস্তুত থাকে।

উজবেকদের আতিথেয়তার আর একটা নমুনা দেখেছিলাম ওখানকার এক ওলীমা অনুষ্ঠানে। আমরা উজবেকিস্তান পৌঁছার দু’দিন পরেই ছিল মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবের পুত্রের ওলীমা। আমাদেরও সেখানে যাওয়া হয়। তাদের রীতি অনুসারে ফজরের পরক্ষণেই পুরুষদের জন্য খাওয়ার আয়োজন। আর মাগরিবের পর ছিল মহিলাদের জন্য আয়োজন। বিশাল কমিউনিটি সেন্টার। রাস্তা থেকে সেন্টারের ভেতর খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত দুই ধারে সারি বেঁধে মেজবানের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে আগত মেহমানদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। টেবিলে টেবিলে আগ থেকেই সাজানো আছে রকমারি খাদ্য-খাবার। প্রত্যেকটা টেবিলে যেন বুফের আয়োজন। কত রকমের তাজা ফ্রুট, কত রকমের ড্রাই ফ্রুট, কত রকমের শরবত, কোল্ডড্রিংস ও পানীয় তা গণনা করা কঠিন। সাথে নানান রকম রুটি ও তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পিলাভ তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে প্রত্যেকটা টেবিল মাঝখানে ফুলদানি দিয়ে সাজানো। আমি আমার জীবনে এমনভাবে সাজানো খাবার টেবিল কখনও দেখিনি। ভেতরে প্রবেশ করেই শুনতে পেলাম কুরআন হাদীছের আলোকে বিবাহের গুরুত্ব, ফযীলত ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনার পর দুআ হলো। তারপর খাওয়া দাওয়া। ওলীমার এ অনুষ্ঠানটি অনেক দিক থেকেই ছিল আমাদের থেকে ব্যতিক্রম।

Leave a Reply