মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
উজবেকদের ধর্মকর্ম ও ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার
উজবেকিস্তানে ৯৫% এর বেশি মুসলমান। সমস্ত মুসলমানই হানাফী মাযহাব
অনুসারী। উজবেকিস্তান এক সময় ছিল ইসলামের একটি কেন্দ্র। কালক্রমে ধর্মবিদ্বেষী
রাশিয়ান শাসনাধীনে চলে যায়। সুদীর্ঘ একশত পচিশ বছর রাশিয়ান শাসনাধীনে থাকার পর ১৯৯১ সনে উজবেকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। ধর্মকর্মের উপর থেকে
বিধি-নিষেধ অনেকটা অপসারিত হয়। উজবেক মুসলমান আবার প্রকাশ্যে ধর্মকর্ম করার
পরিবেশ ফিরে পায়। তবে এই দীর্ঘ একশত বিশ বছরে ধর্মহীনতা, পর্দাহীনতা
ও উলঙ্গপনার যে স্তরে তারা পৌঁছে গিয়েছিল সেখান থেকে অনেকটা উঠে এলেও এখনও
পুরোপুরি উঠে আসতে সক্ষম হয়নি। এখনও সে দেশের নারীরা ব্যাপকভাবে বোরকা ছাড়াই
চলে। এমনকি গায়ে একটা ওড়না পর্যন্ত রাখে না। দুই চারজন নারীকে হিজাব পরিহিত দেখা
গেলেও নেকাব কারোরই নেই। সকলেরই চেহারা খোলা। উজবেক উলামায়ে কেরাম থেকে জানতে
পারলাম চেহারা ঢাকায় সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুরষদের লম্বা দাড়ি রাখায়ও
কিছুটা সরকারী জটিলতা রয়েছে। ফলে উলামায়ে কেরামের মুখেও খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক
আলেমের দাড়ি সম্পূর্ণ সেভ। লম্বা দাড়িওয়ালা লোক হয়তো হাজারে একজন। আলেমদের
গায়েও সুলাহাদের লেবাস নেই। সাধারণ মানুষের মতো তারাও প্যান্ট ও শার্ট বা হাতা
কাটা ঢোলাঢালা গেঞ্জি পরিহিত থাকে। অনেক ইমাম নামাযের সময় জুব্বা পরে নামায
পড়ান। নামাযের পর আবার সেই প্যান্ট গেঞ্জি। চোখের সামনেই আমরা এমনটা দেখেছি।
আমরা তিনজন যে পোশাকে ছিলাম -পায়জামা, লম্বা
পাঞ্জাবী, টুপি (সেই সঙ্গে আছে লম্বা দাড়ি)- ওদেশে এ রকম পোশাকের একটা
লোকও আমাদের নজরে পড়েনি। যখন প্রথম তাশকেন্ত এয়ারপোর্টে নামি, এক
বাঙালির সাথে দেখা। সে ওদেশেই থাকে, ওখানেই বিয়ে থা করেছে, ওখানেই
ব্যবসা বাণিজ্য করে। সে আমাদের বলেছিল, আপনাদের এই পোশাক দেখে
অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে আপনাদের দিকে তাকাবে। আপনাদের ছবি নিতে চাইবে। কারণ এরকম পোশাকের লোক এ
দেশে দেখা যায় না। বাস্তবেও তাই – অনেক স্থানে লোকেরা আমাদের নিয়ে সেলফি তুলতে
চেয়েছে। কিন্তু এটাকে আমি গোনাহ মনে করি বলে অনুমতি দিইনি। প্রথম যখন তাশখন্দের
এক হোটেলে উঠলাম, হোটেল থেকে বের হতেই প্রায় অর্ধ উলঙ্গ এক
মহিলা আমাদের দেখে সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ কিছুক্ষণ আমার দাড়ির দিকে ইশারা করে কী
কী যেন বলল। আমি বললাম, I don’t understand
your language. speak in english. অর্থাৎ, আমি তোমার ভাষা বুঝি না, তুমি
ইংরেজিতে বলো। সে ইশারায় বোঝালো ইংরেজি জানে না। তখন আমি OK বলে
তার সামনে থেকে সরে গেলাম। দাড়ির দিকে ইশারা করে সে কী বলেছিল সে জানে আর তার
খোদা।
আমাদের এই লেবাস-পোশাক ও দাড়ি দেখে ওদেশের বহু লোক বিশেষ সম্মান ও ভক্তিও
নিবেদন করেছে। এমনও হয়েছে আমরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি বা হাঁটছি, দ্রুতগামী
কোন গাড়ি যাচ্ছে, আমাদের দেখে গাড়ির স্পিড কমিয়ে জানালা খুলে
আমাদের সালাম করেছে। চেহারাতে ভক্তির ছাপ দেখা গেছে।
উজবেকিস্তানে হাজার হাজার মাদরাসা ছিল, রাশিয়ান
সরকার সেগুলো ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিছু না ভাঙ্গলেও বন্ধ করে দিয়েছিল। এখনও সেগুলো
বন্ধই রয়েছে। বুখারার এক আলেম থেকে জানলাম কেবল বুখারাতেই ২৮০ টি মাদরাসা ছিল।
যার মাত্র তিনটা বর্তমানে চালু রয়েছে। বাকি সবগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বন্ধ অবস্থায়
বিরান পড়ে আছে। বুখারা, সমরকন্দ, তাশখন্দ প্রভৃতি এলাকায়
পর্যটকরা বিরান পড়ে থাকা এরকম বহু মাদরাসা পরিদর্শন করে থাকে। বিশাল বিশাল ইমারত
জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। নেই উস্তাদ ও আলেম উলামার পদচারণা। নেই তালিবে ইলমদের
আনাগোনা। শুধু নীরব দাঁড়িয়ে আছে ইট সুরকির প্রাণহীন স্থাপনাগুলো। একসময় যেগুলো
ক্বালাল্লাহ ক্বালার রসূল ধ্বনীতে গুঞ্জরিত হত, আজ সেগুলোতে সুনসান নীরবতা।
পর্যটকদের গমনাগমন রয়েছে বিধায় দুই এক জায়গায় কিছু লোক এটা সেটার পসরা সাজিয়ে
বসে আছে। বর্তমান সরকার থেকে এ মাদরাসাগুলো চালু করার অনুমতি পাওয়া যায় না।
ওখানকার একজন আলেমের মুখে শুনলাম উজবেকিস্তান রাশিয়া থেকে স্বাধীন হলেও রাশিয়ার
মর্জি উপেক্ষা করে চলতে পারে না। তিনি বললেন, বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান তো
পুতিনেরই সেবাদাস।
দ্বীনী ইলম ও উলামায়ে কেরামের এক বিশ্বখ্যাত
মারকায আজ শুধু ইতিহাস হয়ে পড়ে আছে। বলছি উজবেকিস্তানের কথা। তবে উজবেকরা আস্তে
আস্তে তাদের হারানো ঐতিহ্যে উঠে আসবে বলে মনে হয়। এখন উজবেক ছেলেরা মদীনা
ইউনিভার্সিটি ও জামেয়া আজহারের মত প্রতিষ্ঠানমুখী হয়েছে। ছুটিতে দেশে আসা
আজহারের কিছু ছাত্রের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। কিছু ছাত্র দেওবন্দ যাওয়ারও চিন্তা
করছে বলে জানলাম। আল্লাহ তাদের কবূল করুন।
উজবেকদের মধ্যে বেশ কিছু ধর্মীয় রেওয়াজ
দেখলাম। তার মধ্যে রয়েছে:
(১) অধিকাংশ মসজিদে ফরয নামাযের
পর সাথে সাথে কোন মুনাজাত হয় না। কিন্তু ফরযের পর ধীরে সুস্থে কিম্বা সুন্নাত
থাকলে সুন্নাত পড়ে সব মুসল্লী বসে থাকে। ইমাম সাহেব বা মুআযযিন সাহেব আয়াতুল
কুরছী পড়েন, সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ, লাইলাহা
ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ইত্যাদি পড়েন। মুসল্লীরাও
পড়েন। তারপর মুনাজাত হয়। তারপর ইমাম সাহেব বা মুআযযিন সাহেব কুরআনে কারীমের কোন
এক জায়গা থেকে কিছু তিলাওয়াত করেন। তারপর আবার মুনাজাত হয়। তারপর কিছু দুআ
দুরূদ পড়ে আবার মুনাজাত হয়। অধিকাংশ মসজিদে এভাবে প্রতি ওয়াক্তে তিনবার মুনাজাত
হয়। দুই এক মসজিদে পেলাম দুইবার মুনাজাত হয়। ফরয নামাযের সাথে সাথে মুনাজাত, তারপর
সব নামায শেষে আবার দুই বার মুনাজাত এমনও এক মসজিদে পেয়েছি। ওখানকার একজন আলেমকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম এভাবে পাশাপাশি তিনবার মুনাজাতের কী হেতু? একবারে
সব চেয়ে নিলে কি হয় না? উত্তর দিয়েছিলেন- এটা রেওয়াজ।
(২) আমাদের দেশসহ অন্যন্য দেশে
সাধারণত একজন আরেকজনের কাছে দুআ চাইলে তিনি হয়তো তৎক্ষণাত মুখে কিছু বলে দুআ করে দেন বা বলেন, ইনশাআল্লাহ দুআ করব। পরে তার জন্য সুবিধামত সময়ে দুআ করেন।
কিন্তু উজবেকিস্তানে রেওয়াজ হল- কেউ কারও কাছে দুআ চাইলে তখনই হাত তুলে তার জন্য
দুআ মুনাজাত শুরু করেন। হোক সেটা রাস্তাঘাটে, বাজারে, গাড়িতে
যেকোনো জায়গায় কিম্বা বসা, দাঁড়ানো, হাঁটাচলা
যেকোনো অবস্থায়। কেউ দুআ চাইল, যেখানে যে অবস্থায় থাকুক
সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য হাত তুলে দুআ মুনাজাত শুরু হয়ে গেল। আমাদেরও অনেক জায়গায় এরকম
করতে হয়েছে। নতুবা তারা মন খারাপ করে ফেলে। ওখানকার একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
কেউ দুআ চাইলে সাথে সাথেই তার জন্য হাত তুলে মুনাজাত করতে হবে- এমন কেন? শুধু
মুখে দুআ করে দিলে কিম্বা পরে দুআ করলে কি হয় না? তিনি
উত্তর দিয়েছিলেন সাথে সাথে হাত তুলে দুআ করলে আমাদের দেশের লোকদের এতমীনান বেশি
হয়। যা-ই হোক এটা একটা রেওয়াজই বটে।
উজবেকিস্তানের মসজিদগুলোতে
কয়েকটা জিনিস খুব ভালো লাগল। (১) প্রায় প্রত্যেকটা মসজিদের উযুখানায় প্রচুর সংখ্যক ছোট
সাইজের তোয়ালিয়া রাখা থাকে। এক ধরনের তোয়ালিয়াতে হাতের ছাপ থাকে। সেগুলো
হাত মুখ মোছার জন্য। আর এক ধরনের তোয়ালিয়াতে পায়ের ছাপ থাকে। সেগুলো পা মোছার
জন্য। প্রত্যেক উযুকারী ব্যক্তি দুই ধরনের দু‘টো তোয়ালিয়া নেয় এবং উযু শেষে হাত মুখ ও পা মুছে সেগুলো
নির্দিষ্ট ঝুড়িতে ফেলে দেয়। স্পষ্টতই তোয়ালিয়াগুলো প্রতিবার ব্যবহারের পর
ওয়াশ করা হয়। (২) কোনো
মসজিদে ভেতরে জুতো স্যান্ডেল রাখার ব্যবস্থা নেই। ওদেশে জুতোচোর নেই। সকলেই জুতো
স্যান্ডেল বাইরে রেখে এতমীনানের সাথে নামায পড়তে পারেন। (৩) নামাযের পর যারা আগে বের হন তাদের অনেকে
নিজেদের জুতো স্যান্ডেলের পাশে থাকা অন্যদের জুতো স্যান্ডেলগুলো ঘুরিয়ে সোজা করে
রেখে যান। অনুকরণ করার মতো একটা কাজ! (৪) মসজিদে মুসল্লীদের উপস্থিতির হার আমাদের দেশের তুলনায়
বেশি। ওদেশের সর্বসাকুল্য জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটির মতো। বসতবাড়িও ফাঁকা ফাঁকা।
কিন্তু মসজিদগুলোতে শুধু জুমুআ নয় ওয়াক্তিয়া নামাযেও মুসল্লির সংখ্যা প্রচুর।