মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
উজবেকিস্তান সফরে কোথায় কি দেখলাম তার বর্ণনা শুরু করার আগে উজবেকিস্তান দেশ-এর পরিচয়, তার ভাষা, উজবেকিস্তানের মুদ্রা এবং তার অধিবাসীদের খাদ্য ও ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নিচ্ছি।
উজবেকিস্তান দেশ
উজবেকিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি প্রজাতন্ত্র। এর পশ্চিম ও উত্তরে কাজাখিস্তান, পূর্বে কিরঘিজস্তান, দক্ষিণ-পূর্বে তাজিকিস্তান এবং দক্ষিণে আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। দেশটির ১২টি প্রদেশ রয়েছে। দেশটির রাজধানী শহর তাশখন্দ। স্থানীয়ভাবে উচ্চারণ করা হয় তাশকেন্ত বা তশকেন্ত (Tashkent/Toshkent)। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উজবেক জাতির লোক।
দেশটির আয়তন ৪,৪৭,৪০০ কি. মি.। বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বড়। জনসংখ্যা ৩২,৯৭৯,০০০। ৯৫% -এর অধিক মুসলমান। সমস্ত মুসলমান হানাফী মাযহাব অনুসারী। উজবেকিস্তানে নিরক্ষর পর্যায়ের অশিক্ষিত কেউ নেই।
ঊনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধে (১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে) উজবেকিস্তান রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় এশিয়ায় রুশ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং কিছু প্রতিরোধ সত্ত্বেও উজবেকিস্তানসহ সমগ্র মধ্য এশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকালে উজবেকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১ সেপ্টেম্বরকে উজবেকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়।
উজবেকিস্তান-এর আয়ের প্রধান উৎসের মধ্যে রয়েছে তুলা, গ্যাস ও পর্যটন খাত। ফলমূলও প্রচুর উৎপাদিত হয়। আমরা তাশখন্দ থেকে সমরকন্দ, সেখান থেকে তিরমীয ও বুখারা যাতায়াতের সময় আপেল, আলু বোখারা, বেদানা, কমলা, চেরিফল, তরমুজ, শাম্মাম প্রভৃতির অনেক বাগান দেখতে পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি দেখেছি তুলার ক্ষেত।
অষ্টম শতাব্দীতে যখন আরবরা মধ্য এশিয়া জয় করে, তখন উজবেকিস্তান অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করে। হযরত কুতাইবা ইবনে মুসলিম আল-বাহিলী রহ. (মৃত: ৯৬ হি. মোতাবেক ৭১৫ খ্রি.) হলেন এই বিজয় অভিযানের প্রসিদ্ধ নেতা।
উজবেকিস্তান আমুদরিয়া (জাইহূন নদী/نهر جيحون)-এর উত্তরে অবস্থিত। নদীটির দক্ষিণের তুর্কমেনিস্তান ও খোরাসান এলাকা থেকে তাই উজবেকিস্তানকে বলা হত মাওয়ারাউন্নাহার (ما وراء النهر) তথা নদীর ওপারের এলাকা। উজবেকিস্তানের বুখারা, সমরকন্দ, তিরমীয, তাশখন্দ (শাশ), নাসাফ ইত্যাদি অঞ্চল তাই মাওয়ারাউন্নাহার-এর অন্তর্ভুক্ত। এসব অঞ্চলের উলামায়ে কেরামকে বলা হয় উলামায়ে মাওয়ারাউন্নাহার।
উজবেকিস্তান হচ্ছে বুখারা, সমরকন্দ, তাশখন্দ (শাশ), তিরমীয, খীভা (খুওয়ারিযম) ও নাসাফ-এর ন্যায় ইলমী মারকায সম্বলিত একটি দেশ। উজবেকিস্তান হচ্ছে ইমাম বুখারী, ইমাম তিরমীযী, ইমাম দারিমী, ইমাম আবূ মানসূর মাতুরীদী, হাকীম তিরমীযী, ফকীহ আবুল লাইছ সামারকন্দী, তাফসীরে মাদারিকুত্তানযীল গ্রন্থকার আবুল বারাকাত আন-নাসাফী, হেদায়া গ্রন্থকার বুরহানুদ্দীন মারগীনানী, উসূলুশ শাশী গ্রন্থকার নিজামুদ্দীন শাশী ও ইমাম কাফফাল শাশী প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, ফকীহ এবং আকায়েদ ও উসূলে ফিকহ শাস্ত্রের মনীষীদের দেশ। উজবেকিস্তান হচ্ছে খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী, খাজা আযীযানে আলী রামিতানী, কুতবুল আকতাব হযরত খাজেগী আমকাঙ্গী প্রমুখ নকশবন্দিয়া সিলসিলার মাশায়েখের দেশ। উজবেকিস্তান হচ্ছে দীর্ঘ একশত পচিশ বছর রাশিয়ান শাসনে ইসলামী কর্মকাণ্ড চরমভাবে বিঘ্নিত থাকার পর আবার ধীরে ধীরে ইসলামী জাগরণে ফিরে আসছে এমন একটি দেশ।
উজবেকিস্তান ভ্রমণের উত্তম সময়
উজবেকিস্তান ভ্রমণের সবচেয়ে উত্তম সময় হলো মার্চ থেকে মে ও সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রচুর গরম থাকে। আবার নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রচণ্ড শীত থাকে, তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়, বরফ পড়ে। আমাদের সফর ছিল জুলাইয়ের শেষ ছয় দিন ও আগস্টের প্রথম চার দিন। আমরা ৩৮, ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা পেয়েছি। তবে আমাদের দেশ থেকে একটা ব্যতিক্রমী বিষয় হল ওখানে দিনের বেলায় প্রচুর তাপমাত্রা থাকলেও বিকেল গড়িয়ে আসার সাথে সাথে আবহাওয়া সম্পূর্ণ আরামদায়ক হয়ে আসে।
উজবেকিস্তানের ভাষা
উজবেকিস্তানের প্রধান ভাষা হল উজবেক ভাষা। দেশটির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক এ ভাষায় কথা বলে। কিছু লোক রুশ ভাষায় এবং তাজিকী ভাষায়ও কথা বলে। তুর্কমেন, কাজাক ও কিরঘিজ ভাষাও কিছুটা চলে।
উজবেক ভাষা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আরবি লিপিতে লেখা হত। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ার পর লেনিনের অধীনে এটি লাতিন লিপিতে লেখা শুরু হয়।
উজবেক ভাষায় প্রচুর ফার্সী শব্দ রয়েছে। বিশেষত বুখারা এলাকার লোকদের আঞ্চলিক ভাষাকে অনেকটা ফার্সিই বলা চলে। অতীতে দীর্ঘ একটা সময় ধরে বুখারা পার্সিয়ান শাসনের অধীনস্থ ছিলো। এ এলাকার ভাষায় ফার্সির প্রভাবের পেছনে এটা একটা বড় কারণ। তবে বুখারার ফার্সী আমরা যে ফার্সী পড়েছি সেই কিতাবী ফার্সী বা ইরানের ফার্সী নয়, বুখারী ফার্সী। ফার্সী অনেক শব্দকে তারা আমাদের চেয়ে অন্যরকম করে উচ্চারণ করে। যেমন: নামাযকে তারা বলে নামোয, খাজা (خواجه) শব্দের উচ্চারণ করে খোয়াজা ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ স্পষ্ট ফার্সীতেই করে। যেমন: আমরা কোথাও যাত্রা করতে হলে বলি, আচ্ছা এখন রওয়ানা দেয়া যাক বা চলি কিম্বা চলুন? তারা বলে রফতেম (رفتيم)। এটা বিশুদ্ধ উচ্চারণের ফার্সী। তাই ফার্সী ভাষা জানা থাকলে উজবেকিস্তান সফরে কিছু উপকারই হয়।
আমরা উজবেক ভাষার কয়েকটা কথা শিখে নিয়েছিলাম, যা বেশ মজা দিত। যেমন:
কালাইছেন? অর্থ : কেমন আছেন?
ইয়াহশে। অর্থ : ভাল আছি।
ইসমিং নিমা? অর্থ: তোমার নাম কি?
ইসমিম …। অর্থ: আমার নাম …।
মেন উজবেকচা বিল মাইমান। অর্থ: আমি উজবেক ভাষা জানি না।
ইংলিশ চা কাপের। অর্থ: ইংরেজিতে কথা বলুন।
ইংলিশে বিলা সানমে? অর্থ: তুমি কি ইংরেজি জানো?
রহমত। অর্থ: ধন্যবাদ।
এ কথাগুলোর মধ্যে ওদেশের কারও সঙ্গে দেখা হলেই কালাইছেন? (অর্থাৎ কেমন আছেন?) বলে জিজ্ঞেস করলে তারা ইয়াহশে (অর্থাৎ ভালো আছি।) বলে উত্তর দিত এবং হেসে দিত। হেসে দিত এ কারণে যে, তারা বুঝতো কষ্টেসৃষ্টেই আমরা তাদের ভাষার এই কথাটা শিখে নিয়েছি। সব কথার শেষে ‘রহমত’ তথা ধন্যবাদ বলতে তাদের কোনো কার্পণ্য নেই। আমাদের সফরসঙ্গী মাওলানা আমীনুল ইসলাম সাহেব কোন উজবেকির সাথে সালাম কালাম হলেই কালাইছেন আর রহমত বলার আনন্দ কোনভাবেই হাতছাড়া করতেন না।