You are currently viewing উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (১২)

উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (১২)

মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন 

রেগিস্তান/রেগিস্তান স্কোয়ার

          রেগিস্তান (ریگستان) ফার্সী শব্দ। এর অর্থ বালুময় স্থান বা মরুভূমি। বুলওয়ার গার্ডেন ও গোর আমীর (আমীর তৈমুর সমাধিসৌধ)-এর কাছে এ জায়গাটি। এটি ছিল তিমুরি রাজবংশের সময় সমরকন্দের মূল কেন্দ্র । তখনকার সময়ে এটি ছিল একটি পাবলিক স্কোয়ার তথা একটি জনসমাগম চত্বর। এখানে রাজকীয় ফরমান শোনার জন্য মানুষ জড়ো হত। এছাড়া এখানে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হত। তা দেখার জন্য মানুষ এখানে জড়ো হত। এটিকে রেগিস্তান স্কোয়ার (Registan Square) তথা রেগিস্তান চত্বর বলা হয়।

          পরবর্তীতে এখানে স্মারক ভবন নির্মাণ করা হয়। রেগিস্তান স্কোয়ারকে ঘিরে তিনটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। প্রদত্ত ছবিতে বাম থেকে ডানে: উলূগ বেগ মাদরাসা, তিলাকারী মাদরাসা ও শেরদর মাদরাসা। রেগিস্তানের এই কাঠামোগুলো ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।

          সমরকন্দের যেসব ঐতিহাসিক স্থানে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা তার মধ্যে এই রেগিস্তান চত্বর অন্যতম।

          রেগিস্তানের মাদরাসা তিনটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নরূপ:

 

উলূগ বেগ মাদ্রাসা

          তিমুরি রাজবংশের সময় ৮২৩ হি. মোতাবেক ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে উলূগ বেগ (الوغ بيگ/Ulug Begue) মাদরাসা তৈরী হয়। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে। আমীর তৈমুর লং-এর নাতি শাসক উলূগ বেগ মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন।

          ১৫শ শতাব্দীতে এই মাদ্রাসা মুসলিম প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ছিল। উলূগ বেগ স্বয়ং এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। উলূগ বেগের সরকারের সময় এই মাদ্রাসায় ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত। যেমন যুক্তিবিদ্যা, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। উলূগ বেগ ব্যক্তিগতভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্রহ-নক্ষত্র দর্শন ও গবেষণার জন্য মানমন্দির (Observatory)ও স্থাপন করেছিলেন। তাশখন্দের আমীর তৈমুর মিউজিয়ামে উলূগ বেগ আমলের গ্রহ-নক্ষত্র দেখার যন্ত্রপাতি দেখতে পাওয়া যায়।

   উলূগ বেগ এই মাদরাসায় জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার উপর জোর প্রদান করতেন। বলা হয় বিশেষভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তিনি এ মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন।

          এই মাদরাসায় শিক্ষাদানের জন্য উলূগ বেগ তার রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানাতেন। উল্লেখ্য, উলূগ বেগ নিজেও বিশেষ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। পূর্বে তাশখন্দে যা যা দেখলাম শিরোনামের অধীন আমীর তৈমুর মিউজিয়ামউপশিরোনামে উলূগ বেগের ব্যক্তি পরিচিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

 

তিলাকোরি মাদরাসা

   শেরদর মাদরাসার দশ বছর পর  তিলাকোরী  (طلاکاری/Tillakori) মাদরাসা নির্মাণ করা হয়। রেগিস্তান চত্বরের বেষ্টনীর একটা বাহু পূর্ণ করার জন্যই মূলত এটি নির্মাণ করা হয়। ১৬৪৬-১৬৬০ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়। এটিও পূর্বে উল্লেখিত উজবেকিস্তানের সামরিক নেতা ইয়ালা বেজতূশ বাহাদুর (يالا بجتوش بهادر)-এর নির্দেশে নির্মিত হয়। এটি ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল, কিন্তু মসজিদ হিসেবেও ভূমিকা পালন করত। কারণ তখন পার্শ্ববর্তী বিবি খানম মসজিদটি (যার আলোচনা পরে আসছে।) জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল।

          তিলাকারী (طلاكارى) শব্দটি ফার্সী। (মূল উচ্চারণ- তিলাকারী, উজবেক উচ্চারণ- তিলাকোরি) এর অর্থ প্রলেপকর্ম। মাদরাসাটির মোজাইক ও কারুকার্যে সোনালি রঙের প্রলেপ লাগানো হয়েছিল বিধায় এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

 

শেরদর মাদ্রাসা

          ১৭শ শতাব্দীতে উজবেকিস্তানের সামরিক নেতা ইয়ালা বেজতূশ বাহাদুর (يالا بجتوش بهادر)-এর নির্দেশে শেরদর (Sher-dor Madrassah/شیردار) মাদরাসা নির্মাণ করা হয়। ১৬১৯-১৬৩৬ সনের মধ্যে এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ইয়ালা বেজতূশ-এর নিজস্ব অর্থে মাদরাসাটি নির্মাণ করা হয়। ইয়ালা বেজতূশ ছোট তৈমুরবলে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

          শেরদর (মূল উচ্চারণ- শেরদার, উজবেক উচ্চারণ- শেরদর) শব্দটি ফার্সী। এর অর্থ হল সিংহযুক্ত। মাদরাসায় প্রবেশের মুখে দুইধারে সিংহের দুটো প্রতীক বানানো আছে। শক্তিমত্তার চিহ্ন স্বরূপ এরূপ করা হয়েছে। এর থেকে মাদরাসাটির নামকরণ হয়েছে শেরদর।

          ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে এ মাদরাসাটিতে দরস চালু হয়। এখানে উজবেকিস্তানের প্রসিদ্ধ উস্তাদগণ তালীম দিতেন। খোরাসান ও ইয়ামান থেকেও বড় বড় আলেমগণ এসে এখানে তালীম দিয়েছেন। এক যুগে শেরদর মাদরাসাকে সমরকন্দের দ্বিতীয় বৃহত্তর মাদরাসা গণ্য করা হত। বিবি খানম-এর মাদরাসা (যার আলোচনা পরে আসছে।)-এর পরেই ছিল এটির স্থান। সোভিয়েত আমলে (১৯৫৭ সালে) পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য মাদরাসা ভবনটিতে ব্যাপক সংস্কার আনা হয়।

 

 

বিবি খানম

          রেগিস্তান স্কোয়ারকে সামনে রেখে দাঁড়ালে ডান দিকে বিবি খানম। বিবি খানম বলে বিবি খানম মসজিদ (ফার্সী: مسجد بى بى خانم) ও মাদরাসাকে বোঝানো হয়। বিবি খানম আমীর তৈমুর লং-এর স্ত্রী। তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। এ মসজিদটি সমরকন্দের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। ১৩৯৯ সালে আমীর তৈমুর লং তার রাজধানী সমরকন্দে একটি আকর্ষণীয় মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী বিবি খানম মসজিদের কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছরে কাজ সমাপ্ত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় কিছু সংস্কারও হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭৪ সালে উজবেকিস্তান সরকার এই মসজিদটি পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করে। ফলে এখন যে মসজিদ দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই নতুন এবং এর প্রতিষ্ঠাকালীন কোন কাজ এখন আর অবশিষ্ট নেই। এখন এ মসজিদে কোন আজান বা নামায হয় না। শুধু ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে মানুষ এটা দেখতে আসে। এক কালে জমজমাট এই মসজিদ এখন কেবলই এক পর্যটনকেন্দ্র।

          বিবি খানম কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢোকার পর বাম দিকে বিবি খানমের কবর রয়েছে।

এখানে যে মাদরাসা রয়েছে এক সময় এটি ছিল সমরকন্দের সর্বশ্রেষ্ঠ মাদরাসা। এখন সেটি শুধু পর্যটকদের দর্শনকেন্দ্র হিসেবেই রয়ে গেছে।

 

Leave a Reply