মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
ইমাম বোখারির মাজার
সমরকন্দে আর একটি বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয় হল হযরত ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি.) রহ.-এর কবর যিয়ারত। ২৮/৭/২৪ রবিবার বিকেলে ছুটিতে দেশে আসা সমরকন্দের অধিবাসী জামেয়া আজহারের ছাত্র সাঞ্জার আমাদেরকে খারতাঙ্গ নামক স্থানে নিয়ে গেল। তার সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন। খারতাঙ্গে ইমাম বুখারির মাজার। খারতাঙ্গ সমরকন্দ শহরের মিডল পয়েন্ট থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে পনের কিলোমিটারের মত দূরে। সাঞ্জারের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্থানটির নামের সঠিক উচ্চারণ কি- খারতুঙ্গ না খারতাঙ্গ? সে বলেছিল, খারতাঙ্গ।
ইমাম বুখারী রহ.-এর বাড়ি বুখারাতেই ছিল। তিনি সে বাড়িতেই থাকতেন। বাড়ির খুব নিকটেই এক স্থানে হাদীছের দরস দিতেন। তার বাড়ি ও দরসের স্থান এখনও চিহ্নিত ও সংরক্ষিত রয়েছে। সামনে ‘বুখারায় যা যা দেখলাম’ শিরোনামের অধীনে সেগুলোর আলোচনা আসছে। সেখান থেকে ইমাম বুখারির খারতাঙ্গ আসার ইতিহাস আলেমের দ্বীনী আত্মমর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। ঘটনা এরূপ। একবার বুখারার শাসক ইমাম বুখারির নিকট আব্দার করেছিলেন তিনি যেন তার (শাসকের) বাড়িতে গিয়ে তার পুত্রকে তালীম দিয়ে আসেন। শাসকের আব্দার তো আদেশই হয়ে থাকে। ইমাম বুখারী এটাকে আত্মমর্যাদা পরিপন্থী মনে করে অস্বীকৃতি জানান। শাসক তখন বলেন, তাহলে আমি এবং আপার পুত্র আসব, তবে আমাদেরকে অন্যদের সাথে নয় বরং পৃথকভাবে তালীম দিবেন। ইমাম বুখারী এটাকেও আত্মমর্যাদা পরিপন্থী মনে করলেন এবং বললেন, তালীম নিতে চাইলে সকলের সঙ্গে একসাথে মিলে তালীম নিতে পারবেন। এতে শাসক ক্ষিপ্ত হন এবং এরই জের ধরে তিনি ইমাম বুখারীকে বুখারা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। তিনি সমরকন্দে চলে আসেন। খারতাঙ্গ এলাকায় তার আত্মীয়দের কাছে অবস্থান করতে থাকেন। এদিকে বুখারার সেই শাসকের সঙ্গে সমরকন্দের শাসকের সম্পর্ক ছিল। ইমাম বুখারী জানতে পারলেন তার এখানে অবস্থান তার আত্মীয়দের জন্য অমঙ্গলের কারণ হবে। তখন ইমাম বুখারী দুআ করলেন, হে আল্লাহ! পৃথিবী প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও আমার জন্য সংকুচিত হয়ে এসেছে, তুমি আমাকে তোমার কাছে তুলে নাও। পরে এখানেই তার ওফাত হলো।
আমরা ইমাম বুখারির মাজারে গিয়ে দেখি মাজার ও মাজার কমপ্লেক্সের উন্নয়ন কাজ চলছে। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। অগত্যা মাজার কমপ্লেক্সের বাম পাশে কবর থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে যিয়ারত সম্পন্ন করলাম। মনের মধ্যে একটু অতৃপ্তি রয়েই গেল। পরে সাঞ্জার ও তার সঙ্গীরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমাদের কমপ্লেক্সের ভেতর প্রবেশ করার অনুমতি নিতে সক্ষম হয়, তবে একেবারে কবরের কাছ পর্যন্ত নয়, কমপ্লেক্সের ভেতর মসজিদ পর্যন্ত। সেই মসজিদের সামনে কেবলার দিকে ইমাম বুখারির কবর অবস্থিত। সেই অতৃপ্তি দূর হল না। মনে হল- তবুও তোমার দেখা রইল বাকি!
কমপ্লেক্স-এর পাশে (কমপ্লেক্সকে সামনে রেখে দাঁড়ালে ডান কোণায়) একটি মাদরাসা রয়েছে। তখন মাদরাসাটি বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করে দেখার সুযোগ হয়নি। একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম এখানে শুধু হাদীছের তালীম হয়।
ফকীহ আবুল লাইছ সমরকান্দির কবর
ইমাম বুখারী কমপ্লেক্স থেকে ফিরে এসে ফকীহ আবুল লাইছ সামারকান্দির কবর যিয়ারতে যাওয়া হল। কবরটি সমরকন্দের চকারদীজা এলাকায় ইমাম আবূ মানসূর মাতুরীদীর কবর কমপ্লেক্সের অদূরে মহল্লার এক বাড়ির ভেতরে। তখন প্রায় ইশার সময়। ওদেশে রাতে সব যিয়ারতের স্থান বন্ধ থাকে। বিশেষকরে সরকারিভাবে যেগুলো যিয়ারতের স্থান হিসেবে চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত। কিন্তু এ কবরটি তার ব্যতিক্রম হওয়ায় তদুপরি একটি বাড়ির ভেতর হওয়ায় রাতের বেলায়ও যিয়ারত করতে পারলাম।
ফকীহ আবুল লাইছ সমরকান্দী (মৃত : ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর নাম নসর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ। ‘ইমামুল হুদা’ ছিল তার উপাধি। তিনি ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিছ, মুফাসসির ও ফকীহ। তার রচিত একাধিক কিতাব রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে তাম্বীহুল গাফিলীন ও বুস্তানুল আরিফীন বহু প্রসিদ্ধ। ‘বাহরুল উলূম’ নামে তার একটি তাফসীরের কিতাবও রয়েছে। এটি রেওয়ায়েত ভিত্তিক তাফসীর গ্রন্থ। এ ছাড়াও তার রচিত কিতাবাদির মধ্যে রয়েছে-
• উয়ূনুল মাসাইল,
• তাসানীফু নাফীছাহ,
• ফাতাওয়া আন-নাওয়াযিল ও
• কিতাবু মুখতালিফির রিওয়াইয়াহ।