লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল আপনারা ইনসাফের সাথে ভেবে দেখুন তো-
উলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কি আসলেই সাম্প্রদায়িক?
বুদ্ধিজীবী সমাজ ও তাদের সমমনা কিছু লোক আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে খারাপভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে থাকেন। এ সম্বন্ধে কিছু বলার পূর্বে সাম্প্রদায়িক কথাটার কি অর্থ তা একটু উল্লেখ করে নিচ্ছি।
বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ য়ে সাম্প্রদায়িক শব্দের দু’টো অর্থ লেখা হয়েছে। একটা অর্থ লেখা হয়েছে- “সাম্প্রদায়িক অর্থ দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সম্পর্কিত।” এ অর্থেই বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বা কৃষ্টি-কালচারগত অনুষ্ঠানকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান। এ অর্থেই বলা হয় মুসলমান সম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায়, খ্রীস্টান সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায় ইত্যাদি। প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনাগত পরিচয়ে বা আদর্শিক পরিচয়ে বা ধর্মীয় পরিচয়ে যে একটা দলীয় পরিচিতি গড়ে ওঠে তার ভিত্তিতেই তাকে এক একটা সম্প্রদায়ভুক্ত আখ্যায়িত করা হয়। এ অর্থে প্রত্যেকেই সাম্প্রদায়িক। কেননা প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনাগত পরিচয়ে বা আদর্শিক পরিচয়ে বা ধর্মীয় পরিচয়ে একটা দলীয় পরিচিতি অবশ্যই থাকে। অতএব সেই পরিচয়ে সে যে কোন একটা সম্প্রদায়ভুক্ত তথা সাম্প্রদায়িক। এ অর্থে সাম্প্রদায়িক কথাটা নিন্দনীয় নয়। সুতরাং এ অর্থে আলেম সমাজ বা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক বলে খারাপভাবে চিত্রিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এ অর্থে তো সকলেই সাম্প্রদায়িক।
সাম্প্রদায়িক শব্দের দ্বিতীয় অর্থ লেখা হয়েছে- “সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিবিশিষ্ট।” এই অর্থটা নিয়ে একটু বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন হলে তাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনাগত কিছু ভেদ-ভিন্নতা বা আদর্শগত কিছু ভেদ-ভিন্নতা বা ধর্মীয় কিছু ভেদ-ভিন্নতা তো থাকবেই। একজনের এরূপ ভেদ-ভিন্নতা যদি অন্যের জন্য পার্থিব কোন সমস্যা না ঘটায় তাহলে এরূপ ভেদ-ভিন্নতার নিন্দা করার কিছু নেই। এই ব্যাখায়ও তো প্রত্যেকেই সাম্প্রদায়িক। তাহলে কি কোন বাছ-বিচার ছাড়া সকলেই নিন্দনীয়? নিশ্চয়ই তা নয়। অতএব এই ব্যাখাতেও সাম্প্রদায়িক হওয়া কোন নিন্দনীয় কিছু নয়।
তবে হ্যাঁ সংজ্ঞায় উল্লেখিত ‘ভেদবুদ্ধিবিশিষ্ট’ কথাটির অর্থ যদি হয় ভেদ বা ভিন্নতার কারণে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি কুবুদ্ধি প্রয়োগের চিন্তাবিশিষ্ট হওয়া, তাহলে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। কেননা এরূপ চিন্তা অন্য সম্প্রদায়ের সমস্যা ঘটাবে। তাহলে একটু সরল করে বক্তব্য এভাবে পেশ করা যায় যে, চিন্তা-চেতনাগত ভিন্নতা বা আদর্শগত ভিন্নতা বা ধর্মীয় ভিন্নতার ভিত্তিতে যদি অন্য সম্প্রদায়ের জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করা হয়, অন্য সম্প্রদায়ের কোন ক্ষতি করা হয়, তাহলে অবশ্যই সেই সাম্প্রদায়িকতা নিন্দনীয়। এবং সেটা নিন্দনীয় আক্ষরিক অর্থে সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে নয় বরং অন্য সম্প্রদায়ের সমস্যা বা ক্ষতি করার কারণে।
তাহলে এবার মূল কথায় আসা যাক। আলেম সমাজ বা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অন্য কোন সম্প্রদায়ের জন্য কী সমস্যা সৃষ্টি করেছে যে, তাদেরকে খারাপ অর্থে সাম্প্রদায়িক বলা হয়। বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন, আপনারা নিজেদের কাছে একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন তো-
কখনও কোন দেশের আলেম সমাজ বা মুসলমানরা কি অন্য কোন ধর্মের লোকদের সমস্যা করার জন্য বলেছে যে, অমুক ধর্মের লোকদেরকে এদেশে থাকতে দেয়া হবে না, যেমনটা বিংশ শতাব্দির শেষ দিকে সংঘটিত বসনিয়া হার্জেগোভিনায় যুদ্ধের সময় ইউরোপের এক প্রসিদ্ধ খ্রীষ্টান নেতা কোন রাখঢাক ছাড়াই বলেছিল, ইউরোপ ভূখণ্ডে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে দেয়া হবে না। এটা ছিল নিন্দনীয় অর্থে সাম্প্রদায়িকতা। ইউরোপের খ্রীষ্টানদের এরূপ সাম্প্রদায়িকতা চর্চার ঘটনা তো অনেক। এই তো ফ্রান্সে ২০২০এর অক্টোবরে রসূলের ব্যঙ্গচিত্র এঁকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হয়েছে। অতি সম্প্রতি (এই এপ্রিল/২০২২) সুইডেনের কয়েকটি শহরে কুরআনও পোড়ানো হয়েছে। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতা চর্চাও সুবিদিত। এই সম্প্রদায়ের কিছু ধর্মীয় নেতা তো ইদানিং ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অহরহই বলে যাচ্ছে, মুসলমানদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হবে। আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান কি কখনও এমন সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কোন কাজ করেছে? তাহলে কেন খ্রীষ্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা জ্ঞাপন না করে উল্টো আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করা হয়? বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কি এটাকে ইনসাফ বলে?
বুদ্ধিজীবীগণ নিজেদেরকে আরও জিজ্ঞেস করে দেখুন- কোন দেশের আলেম সমাজ বা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কি অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয় বন্ধ করে দিয়েছে? অন্য সম্প্রদায়ের দোকান-পাট লুট করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে পথে বসিয়েছে? তাদের ধর্ম-কর্মে বাধা দিয়েছে? গায়ে পড়ে দাঙ্গা বাঁধিয়ে তাদেরকে পাইকারীভাবে খুন করেছে? তাদের মা-বোনদেরকে গণহারে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে? তাদেরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে? যেমনটা করছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রদায়িক হিন্দুগণ মুসলমানদের বেলায়। তাহলে কেন হিন্দু সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা জ্ঞাপন না করে উল্টো আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করা হয়? আপনাদের বিবেক কি এটাকে ইনসাফ বলে?
এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে, বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ পৃথিবীতে বিরল- এটা বুদ্ধিজীবীগণও মনে প্রাণে ঠিকই জানেন। তারা এটাও জানেন যে, এখানে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির যে দু’ একটা ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো একটা স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের হীন স্বার্থে করেছে। কিছু ঘটনায় তা সরকারীভাবেও প্রমাণিত হয়েছে। এটা জানা সত্ত্বেও এবং প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করা হয়? বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কি এটাকে ইনসাফ বলে?
বুদ্ধিজীবীগণ নিজেদেরকে আরও জিজ্ঞেস করে দেখুন- কখনও কোন দেশের আলেম সমাজ বা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কি অন্য সম্প্রদায়ের জাতিগত নির্মূলের অভিযান চালিয়েছে? যেমনটা চালিয়েছে অতি সম্প্রতি মায়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুসলমানদের বেলায়। এবং ইসরাঈলের ইয়াহুদীরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের বেলায়। তাহলে কেন বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও ইয়াহুদী সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা জ্ঞাপন না করে উল্টো আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করা হয়? বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কি এটাকে ইনসাফ বলে?
বিগত কয়েক পর্বে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। এখানে আবারও সেটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
استفت قلبك. (رواه أحمد في مسنده برقم ١٨٠٣٥ وقال النووي في الأذكار: حديث حسن.)
অর্থাৎ, তুমি তোমার মনকে (তথা বিবেককে) জিজ্ঞেস করে দেখ। (মুসনাদে আহমদ: হাদীছ নং ১৮০৩৫)