লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
‘মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন’ শীর্ষক লেখাটির আজকের পর্বের বিষয় হল- মনের মধ্যে যেসব ঈমান বিরোধী প্রশ্ন জাগে এবং সে প্রশ্নগুলো ঈমানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো নিরসন কল্পে কিছু কথা। বুদ্ধিজীবীদের মনে যদি এরকম কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে আশা করি আজকের আলোচনা থেকে তা নিরসন করে নিতে সক্ষম হবেন।
ঈমান বিরোধী কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন- ১ : আসলেই সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ আছেন কি?
এর উত্তর হল- সৃষ্টির পরতে পরতে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য রয়েছে। সামান্য একটা পায়ের জুতো, হাতের লাঠি, একটা সুচ পর্যন্ত কোন নির্মাণকারী ছাড়া এমনি এমনি তৈরি হয়ে যায় না। সেখানে মহাবিশ্বের এই বিশাল সৃষ্টিজগত কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই এমনি এমনি হয়ে যায় কীকরে? কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ.
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত্র দিবসের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আলে ইমরান: ১৯০)
আয়াত বলছে, সৃষ্টির সবকিছুতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এই নিদর্শনের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের নিদর্শনও অন্তর্ভুক্ত। অতএব যারা বিশ্বের এতকিছু দেখেও একজন সৃষ্টিকর্তা থাকার অপরিহার্যতা বুঝে নিতে সক্ষম হয় না সেটা তাদের জ্ঞানের ত্রুটি জ্ঞাপন করে।
প্রশ্ন-২ : আল্লাহকে আমাদের কেউ দেখেনি। না দেখে কীভাবে বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি আছেন?
এর উত্তর হল- মানুষের মন আছে না দেখে আমরা বিশ্বাস করি, আত্মা আছে না দেখে বিশ্বাস করি। এভাবে কতকিছুই তো না দেখে বিশ্বাস করি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের যা কিছু আমরা দেখি তার চেয়ে দেখি না এমন জিনিসের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেশি। তাহলে দেখি না বলে বিশ্বাস করব না- এটা যুক্তিযুক্ত কথা নয়। তদুপরি আল্লাহ আছেন তা কেউ দেখেনি এ কথাও ঠিক নয়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজে গিয়ে আল্লাহকে দেখে এসেছেন। আমাদের নবীর একার দেখে এসে বলা এমন বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে, সাধারণ কোটি মানুষের দেখে এসে বলাও সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে না। কারণ আমাদের নবীকে ঘোর কাফেররা পর্যন্ত ‘আল-আমীন’ তথা পরম সত্যবাদী বলে অভিহিত করত। বিশ্বাসযোগ্যতার এতটা নিশ্চয়তা নবী বাদে অন্য কোটি মানুষের মধ্যেও অনুপস্থিত। দুনিয়ার দশ বিশ হাজার, দশ বিশ লক্ষ মানুষ যদি আল্লাহকে দেখেছে বলে সাক্ষ্য দিত তাহলে তা যেমন সন্দেহ দূর হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত, তদ্রূপ বরং তার চেয়ে বেশি আমাদের নবীর একার সাক্ষ্যই সন্দেহ দূর হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ আমাদের নবীর আস্থাযোগ্যতা লক্ষ কোটি মানুষের আস্থাযোগ্যতার চেয়ে বেশি। লক্ষ কোটি মানুষ যোগসাজস করে মিথ্যা বলতে পারে সে সন্দেহ হতে পারে। কিন্তু আমাদের নবীর বেলায় মিথ্যা বলার সন্দেহ ঘোর শত্রুরা পর্যন্ত করতে পারেনি।
প্রশ্ন-৩ : মানুষ মরার পর পঁচে গলে মাটি হয়ে যায়, তার কি আবার পুন:র্জীবন লাভ করা সম্ভব?
এর উত্তর হল- যে আল্লাহ কোন নমুনা ছাড়া প্রথমে বানাতে সক্ষম হলেন, নমুনা এসে যাওয়ার পর পুনরায় অনুরূপ বানানো তো তার পক্ষে কঠিন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কোন নমুনা ছাড়া প্রথমে কোন কিছু বানানো কঠিন থাকে। একবার নমুনা সামনে এসে যাওয়ার পর আবার অনুরূপ বানানো তো সহজ হয়ে যায়। কুরআনে কারীমে এমনই বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
وَهُوَ ٱلَّذِى يَبْدَؤُاْ ٱلْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُۥ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ.
অর্থাৎ, তিনি ঐ সত্তা যিনি প্রথমবার মাখলূককে সৃষ্টি করেন। তারপর পুনরায় তাকে সৃষ্টি করবেন। আর সেটা (পুনরায় সৃষ্টি করা) তো তার পক্ষে অধিকতর সহজ। (সূরা রূম: ২৭)
প্রশ্ন- ৪ : কেউ তো মরার পর পুনরায় জীবিত হয়ে এসে সংবাদ দেয়নি যে, পরকাল বলে কিছু আছে। তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পরকাল আছে?
এর উত্তর হল- কেউ সংবাদ দেয়নি এটা এর প্রমাণ নয় যে, তাহলে সেটা নেই। বিজ্ঞানীরাও তো বলে, মহাবিশ্বের এমন অনেক কিছু রয়েছে যার সম্বন্ধে আমরা জানি না। তাই বলে কি সেগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায়? বস্তুত মরার পর কেউ এসে সংবাদ দিবে- এ ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। কারণ তাতে ঈমান বিল গাইব তথা না দেখে বিশ্বাস করা থাকে না। আল্লাহ পরীক্ষা নিতে চান কে না দেখে তার সব সংবাদে বিশ্বাস স্থাপন করে। সামনে 6 নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে পরকালের সবকিছু আছে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজে গিয়ে দেখে এসে বলেছেন। যাতে মানুষ একেবারেই ঘোরের মধ্যে না থাকে, তাই এতটুকু করা হয়েছে।
প্রশ্ন- ৫ : মরার পর দেখা গেল পরকাল বলে কিছু নেই। তাহলে ধর্মকর্ম পালন করার এতসব কষ্ট সবই তো বৃথা।
এর উত্তর হল- যদি দেখা যায় পরকাল বলে কিছু আছে, তাহলে অবিশ্বাসীদের কী উপায় হবে? যদি পুন:জীবন বলে নাঊযু বিল্লাহ কিছু না থাকে, তাহলে পুন:জীবনও নেই, কোন আফসোসও নেই। তাহলে এখন যারা ধর্মকর্ম করছে তাতেও তাদের কোন আফসোস নেই। আফসোস করার মত আত্মাই যে থাকবে না। কিন্তু যদি থাকে আর সেই জীবনের জন্য কিছু করে যাওয়া না হয়, তাহলে তো আফসোসের শেষ থাকবে না। সর্বোপরি কথা হল- পুন:জীবনের কথা তো বলে গেছেন লক্ষাধিক এমন নবী রসূল যাদের সত্যবাদিতা সর্বজন স্বীকৃত। অতএব সর্বজন স্বীকৃত এসব সত্যবাদী লক্ষাধিক নবীর কথায় পরকালকে বিশ্বাস করে নেয়াই কি নিরাপদ নয়?
প্রশ্ন- ৬ : মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা পরকাল তো কেউ দেখেনি। না দেখা জিনিসকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায়?
এর এক উত্তর তো পূর্বেই দেয়া হয়েছে যে, পরকাল থাকার কথা বলে গেছেন লক্ষাধিক এমন নবী রসূল, যাদের সত্যবাদিতা সর্বজন স্বীকৃত। তাই তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। দ্বিতীয় উত্তর হল- কেউ দেখেনি এ কথা তো ঠিক নয়। সহীহ হাদীছে এসেছে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজে গিয়ে জান্নাত ইত্যাদি পরকালের সব কিছু দেখে এসে বিবরণ দিয়েছেন। আর আগেও বলেছি, আমাদের নবীর একার দেখে এসে বলা এমন বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে, সাধারণ কোটি মানুষের দেখে এসে বলাও সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে না।
প্রশ্ন-৭ : আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে হাজার বছর আগের কুরআন কীকরে চলতে পারে?
এর উত্তর হল- আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান এমন কিছু আবিষ্কার করেনি যা কুরআনের কোন কিছুর সাথে সাংঘর্ষিক। বিজ্ঞান কি আবিষ্কার করেছে সৃষ্টিকর্তা বলে কোন সত্তা নেই? বরং বহু বিজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব থাকার কথাই অকপটে স্বীকার করে গেছেন। বিজ্ঞান কি আবিষ্কার করেছে নামায পড়া ক্ষতিকর? বিজ্ঞান কি আবিষ্কার করেছে রোযা রাখা ক্ষতিকর? বরং বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে নামায পড়া রোযা রাখা সাস্থ্যের জন্য উপকারী। প্রাণী জবাই করে খাওয়ার ইসলামী বিধানের উপকারিতা, খাওয়ার পূর্বে হাত ধুয়ে নেয়ার ইসলামী বিধানের উপকারিতা, দাঁড়িয়ে নয় বরং বসে পানাহারের ইসলামী বিধানের উপকারিতা, খতনা করার ইসলামী বিধানের উপকারিতা, যেসব প্রাণীর মাংস আহার করা ইসলামে নিষিদ্ধ সেই নিষিদ্ধতার উপযোগিতা, মদ গাঁজা প্রভৃতি নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ সেই নিষিদ্ধতার উপযোগিতা, অবাধ যৌনাচারিতা নিষিদ্ধ সেই নিষিদ্ধতার উপযোগিতা- এসব কিছু আধুনিক বিজ্ঞানই প্রমাণ করেছে। এভাবে ইসলামের বহু বিষয়ের উপকারিতা ও উপযোগিতা বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, যেগুলোর বিবরণ দিতে গেলে স্বতন্ত্র গ্রন্থের প্রয়োজন। অনুরূপ আবিষ্কার এখনও অব্যাহতও রয়েছে। তাহলে তো দেখা গেল বিজ্ঞানই দিন দিন প্রমাণ করছে কুরআনের কথা বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আধুনিক বিজ্ঞানই প্রমাণ করছে কুরআন আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে চলতে পারে। বলা যায় আধুনিক বিজ্ঞানই দিন দিন এই বার্তা দিচ্ছে যে, ইসলামী বিধানাবলিই মেনে নেয়া চাই। কারণ ইসলামী বিধানাবলি আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত। বস্তুত সত্যিকারের বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের কোনো সংঘর্ষ নেই- বিজ্ঞানই দিন দিন এটা প্রমাণ করে চলেছে।