লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল-
আপনাদের কিছু কর্মের যৌক্তিকতা ও বিজ্ঞানময়তা নিয়ে একটু ভেবে দেখবেন কি?
বুদ্ধিজীবীগণ আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনেক কিছুকে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক আখ্যায়িত করতে চান এবং কথায় কথায় আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে ধর্মান্ধ ও মধ্যযুগীয় বলে অভিহিত করে থাকেন। তারা এই ধর্মান্ধ ও মধ্যযুগীয় বলে অন্য কিছু নেতিবাচ্যতার সাথে সাথে এটাও বুঝাতে চান যে, আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কেবল ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা নিয়েই অন্ধ হয়ে পড়ে থাকে, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা মধ্যযুগের লোকদের মত অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা পোষণ করে থাকে।
আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কোন্ ধ্যান-ধারণা বা কোন্ বিষয়টা অযৌক্তিক বা অবৈজ্ঞানিক, কীভাবে অযৌক্তিক বা কীভাবে অবৈজ্ঞানিক তার ব্যাখ্যা ও বিবরণ বুদ্ধিজীবীগণ খুব একটা খোলাসা করে দেন না। তাদের কাছে সেরূপ ব্যাখ্যা বিবরণ চেয়ে বিতর্কের পথে আমরা এগুতেও চাই না। তাদের কাছে শুধু এতটুকু নিবেদন করব যে, তারা যা কিছু করেন সেগুলো কতটুকু যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক তা নিয়ে যেন তারা একটু ভেবে দেখেন। এরকম অনেক বিষয়ই রয়েছে যেগুলো নিয়ে তাদেরকে ভেবে দেখবার নিবেদন জানানো যায়। উদাহরণ স্বরূপ মাত্র কয়েকটা প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করছি।
১. নববর্ষ পালন ও বর্ষবরণ প্রসঙ্গ:
নতুন বছর (চাই বাংলা হোক বা ইংরেজি) শুরু একটা হিসেবের ব্যাপার মাত্র। এই বছরের শুরুর দিনের আলাদা কোন রূপ চেহারাও নেই, আলাদা কোন সত্তাও নেই। আবার সেটা একটা সময় মাত্র, যার কোন প্রাণও নেই, বোধও নেই। তাহলে বর্ষবরণের নামে যে সময়কে বর দেয়া হচ্ছে, যাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে সে তো কিছুই বুঝছে না, কিছুই টের পাচ্ছে না। তার তো বুঝার মত সত্তাই নেই! তাহলে এটা কি একটা ছেলেমিপনা নয়? অযৌক্তিক কাজ নয়? এর পেছনে কী যৌক্তিকতা আছে? কী বিজ্ঞানময়তা আছে? বুদ্ধিজীবীগণ তো বিজ্ঞানমনস্কতার কথা খুব বলে থাকেন, তা এখানে কী বিজ্ঞানমনস্কতা রয়েছে? আবার নববর্ষকে স্বাগত জানানোর পদ্ধতি নিয়েও ভাবনার রয়েছে বৈ কি! স্বাগত জানানো হচ্ছে পটকা ফুটিয়ে, বোমা ফাটিয়ে, গোলাগুলি ছুড়ে। স্বাগতম জানানোর কী সব যৌক্তিক (?) ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি!
২. নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রসঙ্গ:
ইদানিং কয়েক বছর আগ থেকে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে নতুন এক ধরনের বর্ণাঢ্য যাত্রা চালু করা হয়েছে। এই শোভাযাত্রায় মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে পেঁচার প্রতিকৃতি, হাতির প্রতিকৃতি, বাঘ ভাল্লুকের প্রতিকৃতি, কিম্ভুতকিমাকার বিভিন্ন রকমের মূর্তি ইত্যাদি রাখা হয়। তা বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি বা বিজ্ঞান কি বলে এসব পেঁচা, হাতি, বাঘ ভাল্লুক ও কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি মানুষের মঙ্গল সাধন করতে পারে? মঙ্গল সাধনে কি এগুলোর কোন ভূমিকা আছে? এখানে বুদ্ধিজীবীদের কী যুক্তিমত্তা কাজ করছে? কী বিজ্ঞানমনস্কতা কাজ করছে?
৩. ইলিশ পান্তা খাওয়া প্রসঙ্গ:
আগের যুগের মানুষ যখন নাস্তার এতসব রকমারি ব্যবস্থা ছিল না, রুটি খাওয়ারও তেমন প্রচলন ছিল না, ব্রেকফাস্ট নামের আধুনিক এতসব আইটেমও ছিল না, তখন তারা নাস্তায় পান্তা ভাত খেয়ে নিত। কখনও শুধু পিয়াজ মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে নিত। কখনও বা ঝাল পিয়াজ দিয়ে ভাজা চিংড়ি মাছ সহযোগে কিংবা ভাজা ইলিশ মাছ সহযোগেও পান্তা ভাত খেয়ে নিত। এটা ছিল নিছক যখন যা ঘটে বা যখন যা জোটে- সেই পর্যায়ের একটা বিষয়। এটা আদৌ কোন আদর্শ হিসেবে ছিল না। কোন রকম আদর্শিক চিন্তা-চেতনা থেকে ইলিশ পান্তা খাওয়া হত না। না এটা কোন ধর্মীয় আদর্শ হিসেবে করা হত, না কোন দলীয় বা গোষ্ঠিগত কিংবা জাতিগত প্রথা-প্রতীক হিসেবে করা হত। তাহলে ইলিশ পান্তা খাওয়াকে বাঙালিদের ঐতিহ্য হিসেবে মূল্যায়ন করার কী আছে? যেকোনোভাবে পূর্বসূরীরা একটা কিছু করে থাকলেই কি সেটাকে পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে তার চর্চা করতে হবে? তাহলে আগের যুগে আমাদের পূর্বসূরীরা মালকাছা দিয়ে (মানে নিতম্বের ফাটলে লুঙ্গি গুঁজে) ক্ষেত-খামারে কাজ করত বলে মালকাছা দেয়াকে পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে তার চর্চা করতে হবে? আগের যুগের মানুষ পাকা বাথরুমের ব্যবস্থা না থাকার সময় অনেকে ধানক্ষেতে পাটক্ষেতে ইয়ে সেরে নিত। তাহলে কি আমরা এটাকেও পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য ধরে নিয়ে তার চর্চা করব? আগের যুগের মানুষ মাটির হাড়ি পাতিলে রান্না করত, মাটির থালা বাসনে খাবার খেত। তাহলে কি আমরা এগুলোকেও পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য ধরে নিয়ে এগুলোর চর্চা করব? আগের যুগের মানুষ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে লম্প বা হারিকেন জ্বালিয়ে আলো গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করত। তাহলে কি এখনও আমরা লম্প হারিকেনকে ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখব? এরকম কতকিছুই তো পূর্বসূরীরা করত, তার মধ্যে ইলিশ পান্তাকেই কেন ঐতিহ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা? এর পেছনে বুদ্ধিজীবীদের কী যুক্তি বা বিজ্ঞানমনস্কতা রয়েছে? তারপরও কথা রয়েছে। বাঙালিরা ইলিশ পান্তা খেয়ে থাকলেও সে খাওয়া কি শুধু পহেলা বৈশাখেই সীমাবদ্ধ ছিল? অবশ্যই না। তবে কেন পহেলা বৈশাখেই ইলিশ পান্তা খাওয়ার ঐতিহ্য পালন করা?
৪. মৃত ব্যক্তির জন্য নীরবতা পালন প্রসঙ্গ:
একজন মানুষ মারা গেলে তার জন্য জীবিতদের কিছু করার থাকে। মৃত ব্যক্তি যেন উপকৃত হয় এমন কিছু তার জন্য করার নৈতিক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু মৃতদের উদ্দেশ্যে করার নামে যদি এমন কিছু করা হয় যা দ্বারা মৃতদের কোনোই উপকার হবে না, তাহলে সেটা এক ধরনের প্রহসন বৈ কি? বুদ্ধিজীবীগণ মৃত ব্যক্তির জন্য নীরবতা পালন করার যে প্রথা চালু করেছেন বা তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে যাচ্ছেন, সেটাও কি এরূপ প্রহসনের পর্যায়ে পড়ে না? এর দ্বারা মৃতদের কী উপকার হয়? এর পেছনে কী যৌক্তিকতা বা বিজ্ঞানমনস্কতা রয়েছে?
৫. শহীদদের উদ্দেশ্যে বেলুনে করে পত্র প্রেরণ প্রসঙ্গ:
কয়েক বছর আগে দেখলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে শাহবাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র প্রেরণ করা হল। কিছু পত্র বেলুনে লাগিয়ে ছেড়ে দেয়া হল। বেলুনগুলো উড়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল। ব্যস শহীদদের কাছে পত্র পৌঁছে গেল। এটাকে হয় বলতে হবে হাস্যকর ছেলেমিপনা কিংবা বলতে হবে শহীদদের সাথে তামাশা। কিন্তু বুদ্ধিজীবীগণ এসবের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি, বরং বোধ করি এর সমর্থনেই ছিলেন। তারা এখানে কোন যৌক্তিকতা বা বিজ্ঞানমনস্কতা খুঁজে পেয়েছিলেন?
৬. যেখানে সেখানে স্মৃতিসৌধ বানিয়ে তাতে সম্মান জ্ঞাপন ও ফুল অর্পন প্রসঙ্গ:
দেশ ও জাতির জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করেন, অবদান রাখেন, তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা এবং তাদের আদর্শ অনুসরণ করার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু পথে ঘাটে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে যেখানে মনে চায় তাদের স্মরণে ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে কিছু নির্মাণ করলেই সেটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায় কোন যুক্তিতে? সেখানে ফুল অর্পন করলে আত্মত্যাগী অবদান রাখা লোকদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন হয়ে যায় কীভাবে? এটা তো বুদ্ধিজীবীগণ যাদেরকে অন্ধকার যুগের লোক বলে আখ্যায়িত করেন সেই জাহেলী যুগের লোকদের মত কাজ হয়ে গেল, যারা পথ চলতে চলতে মনে চেয়েছে তো মরুভূমির মধ্যেই কিছু বালি পাথর জড় করে তার পূজা করেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন শুরু করেছে।
উল্লেখ্য- রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে যে আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়, আমরা বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন রাখব, তারা যেন এর অযৌক্তিকতা ও অবিজ্ঞানময়তার কথা সরকারের কাছে তুলে ধরেন। যেহেতু অযৌক্তিকতা ও অবিজ্ঞানমনস্কতার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। তারা বিষয়টা সরকারের কাছে তুলে ধরলে হয়তো অবস্থার প্রতিকার হবে। এসব বিষয়ে সরকার তাদের কথার মূল্যায়ন করে থাকে।
বুদ্ধিজীবীগণ যদি প্রকৃতপক্ষেই সব রকম অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চান, তাহলে উপরোল্লিখিত সব ব্যাপারেই তাদের সেরকম অবস্থান নেয়া চাই।