লেখা : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল আপনারা ইনসাফের সাথে ভেবে দেখুন তো-
উলামায়ে কেরাম কি আসলেই ধর্মান্ধ বা ধর্মব্যবসায়ী?
বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা অনেকে কথায় কথায় আলেমদেরকে ধর্মান্ধ, ধর্মব্যবসায়ী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তাহলে ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী কথা দু’টোর একটু ব্যাখ্যা করে দেখা যাক প্রকৃতপক্ষেই উলামায়ে কেরাম ধর্মান্ধ বা ধর্মব্যবসায়ী কি না।
ধর্মান্ধ প্রসঙ্গ
ধর্মান্ধ কথাটার তিন রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। যথা:
(১) ধর্মান্ধ অর্থ ধর্মের নামে যে অন্ধ অর্থাৎ ধর্মের প্রতি যার অন্ধের ন্যায় বিশ্বাস। কোনোরূপ যুক্তি দ্বারা বোধগম্য না হলেও, দলীল-প্রমাণ সামনে না থাকলেও যে তার ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ীভাব পোষণ করে। এ অর্থে ধর্মান্ধ হওয়া দোষণীয় নয়। বরং এ অর্থে প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসীকেই ধর্মান্ধ হতে হবে। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা যুক্তি দ্বারা বোধগম্য করা সহজ নয়, আবার দলীল-প্রমাণ সকলের সংগ্রহ করার অপরিহার্যতাও নেই। বরং ধর্মে আছে- এতটুকু জানাই যথেষ্ট। ধর্মে আছে এতটুকু নিশ্চিতভাবে জানতে পারলেই সে তার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ীভাব পোষণ করবে। অতএব এ অর্থে ধর্মান্ধ হওয়া কোন দোষের নয়।
(২) ধর্মান্ধ অর্থ ধর্মে আছে কি না, ভাল করে না জেনে না বুঝেই অন্ধের মত যে ধর্মের কথা বলে তথা অজ্ঞতার সাথে যে ধর্মের কথা বলে। এ অর্থে ধর্মান্ধতা অবশ্যই নিন্দনীয়। ধর্মের কথা বলতে গেলে, ধর্মের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে গেলে অবশ্যই ভালভাবে জেনে বুঝে বসীরত তথা বিচক্ষণতার সাথেই তা করতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরকম বিচক্ষণতার সাথেই ধর্মের দিকে মানুষকে ডেকেছেন। নবীর প্রতিনিধিত্বকারী উলামায়ে কেরামও কুরআন হাদীছের দলীল-প্রমাণ সামনে রেখে বিচক্ষণতার সাথেই মানুষকে ধর্মের দিকে ডাকেন। কুরআনে কারীমে এসেছে- আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন,
قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ ۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي.
অর্থাৎ, হে নবী! তুমি লোকদেরকে বল (জানিয়ে দাও)- এই আমার পথ (ও পন্থা)। আমি ও আমার অনুসারীগণ বিচক্ষণতার সাথেই আল্লাহর দিকে ডাকি। (সূরা নাহল: ১২৫)
অন্য এক আয়াতে এসেছে-
قُلْ إِنِّى عَلَىٰ بَيِّنَةٍۢ مِّن رَّبِّى وَكَذَّبْتُم بِهِ.
অর্থাৎ, হে নবী! তুমি লোকদেরকে বল (জানিয়ে দাও)- আমি আমার প্রতিপালকের দলীল-প্রমাণের উপরই রয়েছি। কিন্তু তোমরা তাকে মিথ্যা জেনেছো। (সূরা আনফাল: ৩২)
সুতরাং ধর্মান্ধ কথাটার এই দ্বিতীয় অর্থে -যা নিন্দনীয়- আল্লাহর নবীও ধর্মান্ধ নন, আল্লাহর নবীর প্রতিনিধিত্বকারী আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী উলামায়ে কেরামও ধর্মান্ধ নন।
(৩) ধর্মান্ধ কথাটার তৃতীয় অর্থ যা কোন কোন অভিধানে লেখা হয়েছে যে, ধর্মান্ধ হল যে পরধর্ম বিদ্বেষী, গোঁড়া প্রভৃতি। তা এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হল- ইসলামে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ রাখার কোনো শিক্ষা নেই। তবে হ্যাঁ ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম সঠিক নয়- এটা জেনে অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে কল্যাণকামিতার চেতনা নিয়ে ইসলাম ধর্মের দিকে আহ্বান জানানোর শিক্ষা রয়েছে। এটাকে আদৌ অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বলা যায় না। এটা তো অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কল্যাণকামিতা। অতএব ধর্মান্ধ কথাটার এই তৃতীয় অর্থেও -যা নিন্দনীয়- উলামায়ে কেরাম ধর্মান্ধ নন। অভিধানে ধর্মান্ধ-এর পরিচয়ে যে গোঁড়া শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, তা গোঁড়া অর্থ নিন্দনীয় অর্থে ধর্মান্ধ। আর উলামায়ে কেরাম যে নিন্দনীয় অর্থে ধর্মান্ধ নন সে ব্যাখ্যা তো পূর্বেই দেয়া হয়েছে। যারা একগুঁয়ে বা অন্যায়ের উপর জেদ ধরে তাদেরকেও গোঁড়া বলা হয়। এ অর্থেও উলামায়ে কেরাম গোঁড়া নন। কেননা কোন অন্যায়ের উপর উলামায়ে কেরাম জেদ ধরেন না। বরং তারা ন্যায়ের উপর জোর দেন, অন্যায় থেকে বিরত থাকার উপর জোর দেন। আর ন্যায়ের উপর জোর দেয়া এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার উপর জোর দেয়া তো জেদ বা গোঁড়ামী নয় তথা নিন্দনীয় নয় বরং প্রশংসনীয়। অতএব যে বুদ্ধিজীবীগণ উলামায়ে কেরামকে ধর্মান্ধ বলেন, তাদেরকে সত্যনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
ধর্ম ব্যবসায়ী প্রসঙ্গ
ধর্ম ব্যবসায়ী অর্থ যে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে তথা ধর্ম দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ লাভ করে। আর ধর্মের কথা সঠিকভাবে বলে কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের কোন উপায় নেই। কারণ ধর্ম কারও ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আসেনি। একমাত্র ধর্মের কোন কথা গোপন করে কিংবা ধর্মের কথা বিকৃত করেই পার্থিব স্বার্থ অর্জন করা সম্ভব। তাহলে কথা এই দাঁড়াল- যারা ধর্মের কোন কথা গোপন করে কিংবা ধর্মের কোন কথা বিকৃত করে পার্থিব স্বার্থ অর্জন করে তারাই ধর্ম ব্যবসায়ী। পক্ষান্তরে যারা ধর্মের কথা সঠিকভাবে প্রচার করেন, তারা তা করেন মানুষকে ধর্মের অনুসারী বানানোর জন্য এবং এভাবে মানুষের ইহকালীন পরকালীন কল্যাণ সাধনের জন্য, তারা ধর্ম প্রচারক, তারা ধর্ম ব্যবসায়ী নন।
এখন দেখার বিষয় হল- উলামায়ে কেরামকে যে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা হচ্ছে, তা কেউ কি আদৌ দেখাতে সক্ষম হবে যে, উলামায়ে কেরাম কুরআন হাদীছের অমুক বিধানটা গোপন রেখেছেন কিংবা বিকৃত করেছেন এবং এভাবে তাদের পার্থিব স্বার্থ অর্জন করেছেন? আদৌ তা দেখাতে সক্ষম হবে না। বস্তুত কুরআন হাদীছের সব ভাষ্যই সকলের সামনে উন্মুক্ত। এবং কুরআন হাদীছের সবকিছুই যে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে তাও সর্বজন স্বীকৃত। তাই কুরআন হাদীছ ভিত্তিক ইসলাম ধর্মের কোন কিছু গোপন করে বা বিকৃত করে স্বার্থ অর্জন করার তথা এই ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার কোন সুযোগই কারও জন্য বাকি নেই। অতএব উলামায়ে কেরামকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা স্পষ্টতই অবাস্তব ও মিথ্যাচার।
যদি কাউকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলতে চাওয়া হয়, তাহলে ইয়াহুদীদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা যেতে পারে। কারণ তারা ধর্মের কথা গোপন করে এবং ধর্মের কথা বিকৃত করে পার্থিব স্বার্থ অর্জন করেছিল। এবং সে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তাওরাতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন বার্তাসহ রজমের বিধান প্রভৃতি অনেক কিছুই তারা গোপন করেছিল বা বিকৃত করেছিল তাদের ভক্তদের ধরে রেখে তাদের থেকে নজরানা পাওয়ার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য। ইয়াহূদী পণ্ডিতরা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের অনেক বিষয় যে গোপন করেছিল তা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে প্রথমেই ইয়াহুদীদের সামনে ব্যক্ত করেছেন। বোখারী শরীফের বর্ণনা এরূপ- তিনি মদীনায় এসে প্রথমেই ইয়াহুদীদের সম্বোধন করে বলেছেন, হে ইয়াহুদী সম্প্রদায়! তোমাদের তো জানা আছে যে, আমি আল্লাহর রসূল। অতএব তোমরা ঈমান আনো। বিশিষ্ট ইয়াহূদী পণ্ডিত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম -যিনি রসূলের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন- তিনিও এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। যদি রসূলের কথা এবং আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর সমর্থন মিথ্যা হত, তাহলে ইয়াহুদী পণ্ডিতরা অবশ্যই তা চ্যালেঞ্জ করত। কিন্তু তারা তা করেনি। এটা স্পষ্টতই প্রমাণ যে, ইয়াহুদী পণ্ডিতরা তাদের ধর্মীয় বিষয়কে গোপন করেছে এবং বিকৃত করেছে। এবং এটা করেছে পার্থিব হীন স্বার্থে। এভাবে তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেছে। অতএব ইয়াহুদী ধর্মের পণ্ডিতরা ধর্ম ব্যবসায়ী। ইয়াহুদী পণ্ডিতদেরকে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য কুরআনে কারীমেও আহ্বান জানানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
وَلاَ تَشْتَرُواْ بِآيَاتِي ثَمَناً قَلِيلاً.
অর্থাৎ, তোমরা আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না। (সূরা বাকারা: ৪১)
তদ্রূপ যদি কাউকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলতে চাওয়া হয়, তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয় পণ্ডিত পুরোহিতদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা যায়। কারণ তারাও ধর্ম ব্যবসায়ী। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ, উপনিষদ ও পূরাণের অনেক স্থানে একত্ববাদের শিক্ষা রয়েছে, এমনকি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনবার্তাও স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের পণ্ডিত পুরোহিতরা সাধারণ মানুষ থেকে এগুলো গোপন রেখে পৌত্তলিকতার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী তথা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়া থেকে মানুষকে দূরে রাখছে। এসব কিছুই তারা করছে তাদের হীন স্বার্থ বহাল রাখার জন্য। যাতে মানুষ একত্ববাদী ও মুসলমান হয়ে না যায় এবং তাদের নজরানা বন্ধ হয়ে না যায়। এভাবে তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছে। অতএব হিন্দু ধর্মের পণ্ডিত পুরোহিতদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলা যায়। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ, উপনিষদ ও পূরাণের অনেক স্থানে যে একত্ববাদের শিক্ষা রয়েছে, এমনকি স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনবার্তাও রয়েছে তার প্রমাণ জানার জন্য সাধারণ পাঠকদের খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার পড়বে না। এর জন্য তারা কবি গোলাম মোস্তফা রচিত বিশ্বনবী গ্রন্থটি দেখে নিতে পারেন। তাতে হিন্দুদের উপরোক্ত গ্রন্থাবলি থেকে এসব বিষয়ের সুস্পষ্ট বরাত তুলে ধরা হয়েছে।
সুতরাং যদি কাউকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলতে চান তাহলে ইয়াহুদীদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলুন, হিন্দুদের ধর্মীয় পণ্ডিত পুরোহিতদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলুন। কারণ তারা ধর্মগ্রন্থের কথা গোপন করে পার্থিব স্বার্থ অর্জন করেছে এবং এখনও করছে। এভাবে তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের পণ্ডিতগণ তথা উলামায়ে কেরাম ধর্ম নিয়ে এমন ব্যবসা কখনও করেননি, এখনও করছেন না, তেমনটা করার সুযোগও নেই। অতএব যে বুদ্ধিজীবীগণ উলামায়ে কেরামকে ধর্ম ব্যবসায়ী বলেন, তাদেরকে সত্যনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।