You are currently viewing মাদ্রাসা শিক্ষা: বৃক্ষ ফলেন পরিচয়তে

মাদ্রাসা শিক্ষা: বৃক্ষ ফলেন পরিচয়তে

লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :

কোন শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা অগ্রহণযোগ্যতা, কোন শিক্ষার উৎকর্ষ অপকর্ষ নিরূপিত হয় সেই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী ফল তৈরি করে তার ভিত্তিতে। “বৃক্ষ ফলেন পরিচয়তে”। অর্থাৎ ফল দ্বারাই বৃক্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। মাদ্রাসা-শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের কী বানাচ্ছে এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতরা সমাজ, দেশ ও জাতিকে কী দিচ্ছে- এ দু’টো বিষয় সামনে রাখলে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রয়োজন, গ্রহণযোগ্যতা ও উৎকর্ষ বুঝতে আর বেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজন থাকবে না। নিম্নে বিষয় দু’টো সম্পর্কিত কিছু ডাটা পেশ করা হল।

মাদ্রাসা-শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের কী বানাচ্ছে?
• মাদ্রাসা-শিক্ষা কুরআন ও সুন্নাহর ধারক-বাহক তৈরি করে। হাফেজে কুরআন, আলেমে দ্বীন, মুফাসসির, মূহাদ্দিছ ও ফকীহ তৈরি করে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষা আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরসূরি ও নায়েবে নবী তৈরি করে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষা দ্বীনের দায়ী ও মুবাল্লিগ তৈরি করে। ইমাম ও খতীব তৈরি করে। জাতির ধর্মীয় শিক্ষক ও আত্মিক পরিশোধনকারী তৈরি করে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষা তার শিক্ষার্থীদের কুরআন সুন্নাহর কিছু আক্ষরিক বিদ্যা শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত থাকে না। বরং তাদেরকে সেই বিদ্যার প্রতিচ্ছবি আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। মাদ্রাসা শিক্ষিতগণ দেশের আদর্শ নাগরিক।
• মাদ্রাসা-শিক্ষা তার শিক্ষার্থীদের নাস্তিক-বেঈমান নয় আল্লাহ্ বিশ্বাসী মুমিন-মুত্তাকী বানায়।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের ধমনীতে ধর্ম, দেশ ও দেশের স্বাধীনতার সাথে বেঈমানি করার রক্ত প্রবাহিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষী- ধর্ম, দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে তারাই আগে ঝাপিয়ে পড়ে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের ধমনীতে দ্বীন-ধর্ম বিরোধী রক্ত প্রবাহিত হয় না। তাদের ধমনীতে নমরূদ, ফেরআউন ও আবূ লাহাবের রক্ত প্রবাহিত হয় না। তাদের ধমনীতে প্রবাহিত হয় আবূ বকর, ওমর, আলী ও সালাহ উদ্দিন আইয়ূবির রক্ত। তারা দ্বীন-ধর্মের জন্য আবূ বকরের দৃঢ় প্রত্যয়, ওমরের তেজোদীপ্ততা, আলী হায়দারের বীরত্ব ও সালাহউদ্দিন আইয়ূবির প্রতিরোধ স্পৃহা নিয়ে গড়ে ওঠে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের রক্তে গাঁজা ইয়াবা পাওয়া যায় না। তারা সব ধরনের নেশাকে হারাম জানে এবং সেভাবেই নিজেদেরকে পরিচালিত করে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের রক্তে বল্গাহীন যৌন অপরাধ থেকে সৃষ্ট এইডস পাওয়া যায় না। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডাক্তার আব্দুল হক সাহেব এক সেমিনারে বলেছিলেন, আমি আজ পর্যন্ত কোন আলেমের মধ্যে এমন কোন রোগ পাইনি যা নৈতিক চরিত্রের অধ:পতনের কারণে হয়ে থাকে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা ইভটিজিং শেখে না। তারা পরনারীকে দেখলে দৃষ্টি নত করতে শেখে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের নামে থানায় থানায় ধর্ষণ হত্যার মামলা হয় না।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের নামে কোর্ট আদালতে ছিনতাই ডাকাতি ও ভূমিদস্যুতার মামলা হয় না।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের হাতে পিস্তল রিভলভার ওঠে না। তাদের হতে ওঠে কুরআন তাসবীহ।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের মুখে অমুকের বাচ্চা তমুক জাদা বুলি ওঠে না। তাদের মুখে ওঠে ক্বালাল্লাহ ক্বলার রসূল-এর বুলি।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের গায়ে বে-দ্বীন বে-ঈমানের পোশাক ওঠে না। তাদের গায়ে ওঠে অলি-আল্লাহ্ ও সালেহীনের লেবাস।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা কচুরিপানার মতো ভিন্ন জাতির আদর্শের শ্রোতে ভেসে যায় না। পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশ-ভূষা, চিন্তা-চেতনা সব ক্ষেত্রেই তারা স্বকীয় আদর্শে অবিচল থাকতে শেখে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা পিতা-মাতাকে ওল্ড হোমে রেখে আসে না। তারা পিতা-মাতার খেদমত করাকে সৌভাগ্য ভাবতে শেখে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা গুরুজনদের সাথে বেয়াদবী করতে শেখে না। তারা গুরুজনকে আদব-তাজীম করতে শেখে।
• মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের মাথায় নয়ছয় করে দুনিয়া কামানোর ধান্দা ঢোকে না। তাদের মাথায় ঢোকে দুনিয়া বিসর্জন দিয়ে আখেরাত অর্জন করার ফিকির।

মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা সমাজকে কী দিচ্ছে?
• এই যে লাখো কোটি মানুষ দ্বীন ঈমান শিখে অনন্তকালের আযাব থেকে মুক্তির পথ লাভ করছে এটা আলেম সমাজেরই অবদান অন্য কারও নয়।
• এই যে লাখো কোটি মসজিদের মিনার থেকে পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহু আকবার- আল্লাহর বড়ত্বের কথা ধ্বনিত হচ্ছে এটা আলেম সমাজেরই অবদান অন্য কারও নয়।
• এই যে লাখো কোটি মানুষ হায়ান-জানোয়ারের জীবন আর আল্লাহর খাঁটি বান্দার জীবনের মধ্যে পার্থক্য শিখছে এটা আলেম সমাজেরই অবদান অন্য কারও নয়।
• এই যে লাখো কোটি মানুষ মাথা থেকে পা পর্যন্ত দ্বীন ও সুন্নাতের অনুসরণ করে আল্লাহর খাঁটি বান্দা ও রসূলের খাঁটি উম্মতে পরিণত হচ্ছে এটা আলেম সমাজেরই অবদান অন্য কারও নয়।
• এই যে লাখো কোটি মানুষ রাস্তাঘাটে, অফিস আদালতে, কলকারখানায়, গাড়িতে লঞ্চে ট্রেনে একে অপরকে সালাম দিচ্ছে, মুসাফাহা মুআনাকা করছে, একে অপরের কাছে দুআ চাইছে এই পরিবেশ সৃষ্টি আলেম সমাজেরই অবদান অন্য কারও নয়।
• এই যে লাখো কোটি মানুষ এখনও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করা, কর্তব্য কাজে ফাঁকি না দেয়া, ঘুষ উৎকোচ গ্রহণ না করা, সরকারি অর্থ আত্মসাত না করা ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়ার কাজে ভূমিকা রাখছেন এই নৈতিক শিক্ষা তারা আলেম সমাজ থেকেই পেয়েছেন অন্য কারও থেকে নয়। অন্যদের অবস্থা তো এই- কয়েক বছর আগে ভার্সিটির এক শিক্ষিকার মুখ ফসকে বের হয়ে গেল যে, পাঠ্যবই পড়ানো আমাদের দায়িত্ব, নৈতিকচরিত্র শিক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়।
• গরীব দুঃখীকে দান-খয়রাত, যাকাত-সদকা ও করযে হাসানাহ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে সমাজের সর্বস্তরে অর্থের প্রবাহ ছড়ানোর মাধ্যমে আর্থ সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কাজ আলেম সমাজই করছেন অন্য কেউ নয়।
• সূদভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে ধনীকে আরও ধনী এবং গরীবকে আরও গরীবে পরিণত করার শোষণমূলক ভারসাম্যহীন পন্থার বিরুদ্ধে আলেম সমাজই সোচ্চার ভূমিকা রাখেন অন্য কেউ নয়।
• আর্ত-পীড়িত ও বিপদ-জর্জরিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করে সমাজে সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠার কাজ আলেম সমাজই করেন অন্য কেউ নয়।
• অফিস আদালত, মিল ফ্যাক্টরি, খামার হ্যাচারি অনেকেই গড়ে তুলতে পারে, পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু যে সততা, দায়িত্বনিষ্ঠা ও নীতি-নৈতিকতা ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানেরই সফলতা আসে না, বরকত আসে না সেই শিক্ষা আলেম সমাজই প্রদান করেন অন্য কেউ নয়। এ ক্ষেত্রে আলেম সমাজের অবদান রয়ে যায় স্থূল দৃষ্টির অন্তরালে।
মাদ্রাসা-শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের কী বানায় এবং মাদ্রাসা-শিক্ষিতরা সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কী করে এ গেল তার সংক্ষিপ্ত ডাটা ভিত্তিক বিবরণ। এর প্রত্যেকটি ডাটা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে তার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ, বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। এ-ই হল “বৃক্ষ ফলেন পরিচয়তে”।
পরিশিষ্টে তিনটি কথা বলে ব্লগটি শেষ করছি।
১. সবকিছুতেই দু’একটা ব্যতিক্রম থাকে। ‘এক্সেপশনাল কেস’ বলে একটা কথা সবক্ষেত্রেই রয়েছে। সেমতে আলেম সমাজের দু’চার জনের মধ্যেও যোগ্যতা ও দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যেতে পারে, আমল ও কাজকর্মে ভুল-ভ্রান্তি পাওয়া যেতে পারে। ধর্ম ও উলামা বিদ্বেষীরা সেই ব্যতিক্রমমূলক দু’চারটে উদাহরণ টেনে আলেম সমাজের ভাবমূর্তি কলুষিত করে দেখানোর অপচেষ্টা করে থাকে। কিন্তু ব্যতিক্রমমূলক উদাহরণ কখনই সর্বসামগ্রিক অবস্থার বিরুদ্ধে দলীল হয় না। “Exception is never an example”.
২. কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে কিছু লোকের অভিযোগ এখানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কেন পড়ানো হয় না, এখানে জজ-বারিস্টার আমলা সচিব কেন তৈরি হয় না? এর অনেক রকমের উত্তর আছে। এক রকমের উত্তর হল- মাদ্রাসার ছাত্র ৫% আর স্কুল কলেজের ছাত্র ৯৫%। ৯৫ পার্সেন্টকে বিজ্ঞান শিখিয়েও কি বিজ্ঞানের হক আদায় হচ্ছে না? ৯৫ পার্সেন্টকে দিয়েও কি জজ বারিস্টার আমলা সচিবের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না? ৫ পার্সেন্টকে অন্তত কুরআন সুন্নায় দক্ষ হওয়ার জন্য রিজার্ভ রাখুন। আর এক রকমের উত্তর হল- কাউকে একই সঙ্গে কুরআন হাদীছ জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুতে পারদর্শী বানাতে চাইলে বাস্তবে তার রেজাল্ট কী দাঁড়ায় আমাদের দেশেরই একটা শিক্ষাধারা তো তার সাক্ষী রয়েছেই। আরও বহু রকমের উত্তর রয়েছে।
৩. সম্প্রতি ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়াতে মাদ্রাসার ফুযালা ও তালাবার বেশে কিছু লোককে গালিগালাজ, অশালীন অভদ্র ভাষা ব্যবহার, গুরুজনদের সাথে বেয়াদবী, ছোট হওয়া সত্ত্বেও বড়দের সমালোচনা ইত্যাদি আদর্শ পরিপন্থী ও অনৈতিক চর্চায় লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। বিচিত্র নয় যে, তাদের অনেকেই প্রকৃতপক্ষে মাদ্রাসার ফুযালা ও তালাবা নয়। বরং ধর্ম ও উলামা বিদ্বেষীরা ফেক আইডি খুলে উলামায়ে কেরামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ফুযালা ও তালাবার বেশে এমনটা করছে। তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকা চাই। প্রকৃতপক্ষেই ফুযালা ও তালাবার মধ্যকার মুষ্টিমেয় যারা ভাবাবেগে কিংবা অসচেতনতা বশত এমনতর নেতিবাচক চর্চায় নেমেছেন, তাদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ আপনাদের মহান ঐতিহ্য ধরে রাখুন, আপনাদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে যাবেন না, আপনাদের আদর্শ বিস্মৃত হবেন না, বৃহত্তর আলেম সমাজের ভাবমূর্তি বিনষ্টের কারণ হবেন না।
আল্লাহ্ আমাদেরকে চিন্তা-চেতনার স্থিতি দান করুন। আমীন!

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

Leave a Reply