You are currently viewing গানের সুরে কুরআন তেলাওয়াতের মাসআলা

গানের সুরে কুরআন তেলাওয়াতের মাসআলা

লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন

بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد:

ইদানিং কিছু লোককে গানের সুরে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করতে শোনা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও হেফজখানার ছাত্রদেরকেও গানের সুরে তেলাওয়াত মাশক করানো হচ্ছে বলে আমাদের শ্রুতিগোচরে এসেছে। এরকম গানের সুরে কুরআন তেলাওয়াত করা সংগত কি না- এ প্রসঙ্গ নিয়েই এখনকার আলোচনা।
গানের সুরে তেলাওয়াত বলতে আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত গানের সুরে তেলাওয়াত হোক বা ইউরোপ আমেরিকায় প্রচলিত গানের সুরে তেলাওয়াত হোক বা আরব অনারব যেকোনো অঞ্চলে প্রচলিত গানের সুরে তেলাওয়াত হোক সবগুলোকেই বোঝানো হয়েছে। সবগুলোর হুকুমই অভিন্ন।
গানের সুরে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করাকে পূর্বসূরী উলামায়ে কেরাম কুরআন হাদীছের আলোকে নিষিদ্ধ বলে আসছেন। হযরত ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে কীভাবে বৈধ সূরতে গেয়ে গেয়ে কুরআন পাঠ করা যায় তার বর্ণনা প্রদানের পর লিখেছেন-

الوجه الثاني: ما كان من ذلك صناعةً من الصنائع، وليس في الطبع السماحة به، بل لا يحصُل إلا بتكلُّف وتصنُّع وتمرُّن، كما يتعلم أصوات الغِناء بأنواع الألحان البسيطة، والمركبة على إيقاعات مخصوصة، وأوزانٍ مخترعة، لا تحصل إلا بالتعلُم والتكلف، فهذه هي التي كرهها السلفُ، وعابوها، وذمّوها، ومنعوا القراءةَ بها، وأنكروا على من قرأ بها.

অর্থাৎ, (গেয়ে গেয়ে পাঠ করার) দ্বিতীয় রূপ হচ্ছে যেটা একটা শিল্প। যা স্বভাব স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং কৃত্রিম অনুশীলন ও কসরত করেই যা অর্জন করা হয়। যেমন সুর আরোপের সরল ও যৌগিক বিভিন্ন প্রকারের সুনির্দিষ্ট তাল ও উদ্ভাবিত মাত্রাযোগে গানের সুর শেখা হয়। এগুলো কৃত্রিম অনুশীলন ছাড়া অর্জিত হয় না। পূর্বসূরীগণ এটাকে অপছন্দ করেছেন, এটাকে দূষণীয় বলেছেন, এর নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। তারা এরকম সুরে কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করেছেন এবং যারা এরকম সুরে পাঠ করে তাদের বিরোধিতা করেছেন।
তিনি আরও লিখেছেন-

وكلُّ من له علم بأحوال السلف، يعلم قطعاً أنهم بُرآء من القراءة بألحان الموسيقي المتكلفة، … ، وأنهم أتقى للّه من أن يقرؤوا بها، ويُسوّغوها.

অর্থাৎ, পূর্বসূরীদের অবস্থা সম্বন্ধে যারা অবগত তারা সকলেই নিশ্চিতভাবে জানেন যে, পূর্বসূরীগণ কৃত্রিমভাবে অর্জিত সংগীতের সুরে কুরআন পাঠ করা থেকে মুক্ত। এরকম সুরে কুরআন পাঠ করতে ও অনুমোদন দিতে তারা আল্লাহকে ভয় পেতেন।
রয়ে গেল গানের সুরে তেলাওয়াত করার বিভ্রান্তিটা এলো কোত্থেকে? যতদূর মনে হয় একটা হাদীছে উল্লেখিত একটা শব্দের অর্থ বুঝতে ভুল হওয়ায় কিছু লোক গানের সুরে তেলাওয়াতের আনুকূল্য বুঝে বসেছে। আগে হাদীছটি ও তার সঠিক অর্থ কি তা উল্লেখ করে নিচ্ছি, তারপর বিভ্রান্তি কোন শব্দ থেকে এসে থাকবে তা উল্লেখ করছি। হাদীছটি এই-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : مَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ ، يَجْهَرُ بِهِ . (رواه البخاري في صحيحه برقم ٥٠٢٤ ومسلم في صحيحه برقم ١٨٨٣ )


অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, আল্লাহ সুন্দর আওয়াজ বিশিষ্ট নবীর -যিনি কুরআনকে (আসমানী কিতাবকে) গেয়ে গেয়ে পাঠ করেন, উচ্চস্বরে পাঠ করেন তার- পাঠকে যতটা মন দিয়ে শ্রবণ করেন অন্য কোনো কিছুকে ততটা মন দিয়ে শ্রবণ করেন না। (বোখারী: ৫০২৪ ও মুসলিম: ১৮৮৩)
তালাবা ও উলামায়ে কেরামের উদ্দেশে উল্লেখ্য যে, এ হাদীছে উল্লেখিত أَذِنَ শব্দের অর্থ অনুমতি দেয়া নয় বরং মনোযোগ দেয়া, মন লাগিয়ে শোনা, কান পেতে শোনা। শব্দটি أذِنَ يَأذَنُ إذْنًا থেকে উদ্ভূত নয়, যার অর্থ অনুমতি প্রদান করা। বরং أذِنَ يَأذَنُ أذَنًا থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা, মন দিয়ে শ্রবণ করা, কান পেতে শোনা। যেমন ইবনুল আছীর আন্নিহায়া ফী গারীবিল হাদীছ গ্রন্থে, বাগাবী শরহুস সুন্নাহ গ্রন্থে, কুরতুবী তার তাফসীর গ্রন্থে, আরও অনেকে অনেক গ্রন্থে বলেছেন, ما أذِنَ الله لشيءٍ অর্থ ما استمع الله لشيء। তাহযীবুল লুগাহ, লিসানুল আরব, মাক্বাঈসুল লুগাহ প্রভৃতি অভিধানেও এরূপ অর্থ লেখা হয়েছে। আর يَتَغَنَّى শব্দের অর্থ এখানে গান গাওয়া বা গানের সুরে পাঠ করা নয়। বরং গেয়ে গেয়ে পাঠ করা। আর গেয়ে গেয়ে পাঠ করা অর্থ সুন্দর স্বরে পাঠ করা। এই يتغنى শব্দ থেকেই কিছু লোকের বিভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে যে, يَتَغَنَّى শব্দের অর্থ যেহেতু অভিধানে ‘গান গাওয়া’- এমনও পাওয়া যায়, তাহলে يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ -এর অর্থ দাঁড়াবে গানের মত কুরআন পাঠ করে। অথচ এখানে يَتَغَنَّى শব্দের অর্থ গান গাওয়া নয় বরং গেয়ে গেয়ে পাঠ করা, আর গেয়ে গেয়ে পাঠ করা অর্থ সুন্দর স্বরে পাঠ করা, যা পূর্বে বলা হল। এবং এ ব্যাখ্যা এক হাদীছ থেকেই প্রমাণিত। হাদীছটি সামনে উল্লেখ করা হচ্ছে।
এখানে يَتَغَنَّى শব্দের দ্বারা গানের সুরে পাঠ করা উদ্দেশ্য হতে পারে না তার বিশেষ দু’টো কারণ উল্লেখ করছি। প্রথম কারণ হল- কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, গান-বাদ্য শরীয়তে হারাম। এর হারাম হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা’ রয়েছে। অতএব যে গান-বাদ্য হারাম তার সুরও অবশ্যই গর্হিত। আর একটা গর্হিত বিষয় পবিত্র কুরআনের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে না। দ্বিতীয় কারণ হল- يتغنى بالقرآن কথাটি تركيب অনুসারে حسن الصوت এর ব্যাখ্যা। আর حسن الصوت বা সুন্দর আওয়াজ বিশিষ্ট বলতে কী উদ্দেশ্য তা ইবনে মাজার এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

عن جابر بن عبدالله أن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – قال: إن من أحسن الناس صوتًا بالقرآن، الذي إذا سمعتموه يقرأ، حسبتموه يخشى الله. (رواه ابن ماجه برقم ١٣٣٩ والحديث صححه الألباني)

অর্থ: হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষের মধ্যে সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতকারী হল সেই যাকে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনলে তোমরা মনে করবে সে আল্লাহকে ভয় করে। (সুনানে ইবনে মাজা: হাদীছ নং ১৩৩৯) এ হাদীছ থেকে স্পষ্ট যে, সুন্দর আওয়াজ হল সেই আওয়াজ যা থেকে আল্লাহর ভয় নির্ঝরিত হয়। অতএব يتغنى بالقرآن (গেয়ে গেয়ে কুরআন পাঠ করে) কথাটি যেহেতু সুন্দর আওয়াজ বিশিষ্ট কথাটিরই ব্যাখ্যা, তাই يتغنى بالقرآن তথা ‘গেয়ে গেয়ে কুরআন পাঠ করে’ দ্বারা গান গাওয়ার মত করে তথা গানের সুরে পাঠ করে তা উদ্দেশ্য হবে না। বরং ‘গেয়ে গেয়ে কুরআন পাঠ করে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হবে সুন্দর স্বরে বা সুন্দর আওয়াজে পাঠ করে। আর সুন্দর স্বরে বা সুন্দর আওয়াজে পাঠ বলতে কী বুঝায় তা তো পূর্বেই হাদীছের বরাতে উল্লেখ করা হল যে, সুন্দর আওয়াজ হল সেই আওয়াজ যা থেকে আল্লাহর ভয় নির্ঝরিত হয়। ফাতহুল বারী ও তাফসীরে খাযেনসহ কিছু কিতাবে আছে- কেউ কেউ يتغنى بالقرآن -এর ব্যাখ্যা করেছেন يستغني به عن الناس অর্থাৎ, কুরআন পাঠ করে মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে। কোন মনীষীই يتغنى بالقرآن -এর ব্যাখ্যা গানের সুরে কুরআন তেলাওয়াত- এমন করেননি।
এসব কিছুর ভিত্তিতে মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম বলেছেন, يتغنى بالقرآن দ্বারা গানের সুরে তেলাওয়াত উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত, সুন্দর স্বরে তেলাওয়াত। যেমন কয়েকজন আলেমের উক্তি উদ্ধৃত করছি। আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ বলেন,

فليس هذا هو التغني، وإنما المقصود بالتغني تحسين الصوت بالقراءة. (شرح سنن ابي داود لعبد المحسن العباد)

অর্থাৎ, এটা ঐই গান গাওয়া নয়। এই গাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য সুন্দর স্বরে পাঠ করা।
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উছাইমীন বলেন,

يتغنى بالقرآن : يعني يقرؤه بصوت حسن. (شرح رياض الصالحين)

অর্থাৎ, يتغنى بالقرآن দ্বারা উদ্দেশ্য সুন্দর আওয়াজে কুরআন পাঠ করে।
শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায বলেন,

التغني بالقرآن، يعني تحسين الصوت به، وليس معناه أن يأتي به كالغناء. (مجموع فتاوى و رسائل الشيخ عبدالعزيز بن عبد الله بن باز – المجلد الثالث عشر.)

অর্থাৎ, কুরআন গেয়ে গেয়ে পড়া মানে সুন্দর আওয়াজে কুরআন পাঠ করা, গানের মত পড়া নয়।
পরিশেষে দু’টো কথা বলে আলোচনা শেষ করছি। এক. সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করা কাম্য। এই সুন্দর আওয়াজ বলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা পূর্বে প্রদান করা হয়েছে। সেমতে প্রত্যেকে তার আল্লাহ প্রদত্ত স্বাভাবিক সুরের সঙ্গে আল্লাহভীতি ও মনের মাধুরী মিশ্রিত করে তেলাওয়াত করলেই সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত গণ্য হবে। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত বলতে সুললিত কন্ঠে তেলাওয়াত উদ্দেশ্য নয়। কারণ সুললিত কন্ঠ কারও এখতিয়ারী বিষয় নয়। দুই. গানের সুরে তেলাওয়াত করার বা কোন গানের সুরের সঙ্গে মেলানোর কোন কসরত ছাড়াই যদি কারও সাবলীল সুর কোন গানের পঙক্তির আওয়াজের সঙ্গে মিলে যায় সেটা নিন্দনীয় হবে না। নিন্দনীয় হবে তখন যখন পরিকল্পিতভাবে ও কৃত্রিমভাবে কসরত অনুশীলন করে গানের সুর প্রদান করা হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের শানে বেহুরমতী করা থেকে রক্ষা করেন। আমীন!

Leave a Reply