মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
আমীর তৈমুর মিউজিয়াম
প্রত্যেক দেশের মিউজিয়ামে (জাদুঘরে) সেই দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক উপাত্ত ও
ডকুমেন্ট থাকে। তাই আমরা সফরের শেষ দিকে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দের জাতীয়
জাদুঘর দর্শনের মনস্থ করলাম।
২/৮/২৪ তারিখ রোজ শনিবার সকালে বেহযাদের গাড়িতে গেলাম আমীর তৈমুর
মিউজিয়াম দর্শনে। মিউজিয়ামটি নিউ তাশখন্দের সেন্টার পয়েন্টে অবস্থিত। যাকে বলে
হার্ট অফ নিউ তাশখন্দ। চরসু বাজার হল পুরান তাশখন্দের সেন্টার পয়েন্ট। আর আমীর
তৈমুর মিউজিয়াম হল নতুন তাশখন্দের সেন্টার পয়েন্ট।
আমাদের হোটেল নোবঝা প্যালেস থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরত্বে আমীর তৈমুর মিউজিয়াম।
সেখানে টিকেট নিতে হল। প্রতি টিকেটের মূল্য ৩৭০০০ সোম। বাংলাদেশী টাকায় ৩২৭ টাকা।
জাদুঘরটিতে রয়েছে উজবেকিস্তানের বিভিন্ন আমলের বিশিষ্ট শাসকদের ছবি ও তাদের
আমলের বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিশেষভাবে সম্রাট তৈমুর লং-এর আমলের সৈন্যদের বিভিন্ন
ধরনের পোশাক ও বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র স্থান পেয়েছে। সম্রাট বাবর ও উলূগ বেগের
স্মৃতিমূলক বিভিন্ন জিনিসও রয়েছে। বিশেষভাবে সম্রাট তৈমুর লং, সম্রাট
বাবর ও উলূগ বেগ-এর স্মৃতিমূলক জিনিসপত্র কেন স্থান পেয়েছে তা বুঝার জন্য সম্রাট
তৈমুর লং, সম্রাট বাবর ও উলূগ বেগ সম্পর্কিত কিছু কথা জেনে নেই। যাতে
উজবেকিস্তানের সঙ্গে এই তিনজনের সম্পর্ক বুঝে আসে।
সম্রাট তৈমুর লং
তৈমুর ইবনে তারাগাই বার্লুস (৯ এপ্রিল ১৩৩৪ –
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৪০৫)। তিনি তিমুরে ল্যাংগ্ (تیمور لنگ) নামেও পরিচিত, যার অর্থ খোঁড়া তৈমুর।
ইউরোপে তিনি ‘তিমুর‘
(Timur) বা ‘তিমুরলেন‘ (Timurlane) নামে পরিচিত।
তার আসল নাম সুজাউদ্দিন বেগ তৈমুর বারলাস । যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি আহত হন, যার
ফলে তার একটি পা অকেজো হয়ে যায় এবং তিনি খোঁড়া বা ল্যাংড়া হয়ে যান।
তৈমুর ১৪শ শতকের মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ। তিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ
অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৩৬৯ থেকে ১৪০৫ সাল
পর্যন্ত নেতৃত্বে আসীন ছিল। তার কারণেই তৈমুরীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা
লাভ করে। এই বংশ কোনো না কোনোভাবে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্বে আসীন
ছিল।
সম্রাট তৈমুরের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান
থেকে নিয়ে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ পর্যন্ত যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কাজাখিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তান, ভারতবর্ষ
এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত অঞ্চলও।
দীর্ঘ ৩৫ বছর (১৩৭০–১৪০৫) উজবেকিস্তানের
সমরকন্দ ছিল তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী। ১৩৬১ সালে
তৈমুর উজবেকিস্তানের কর্তৃত্ব অর্জন করেন। এরপূর্বে ১২১৯ খৃষ্টাব্দে
চেঙ্গিজ খান তাশখন্দ, সমরকন্দসহ গোটা উজবেকিস্তান ধ্বংস করে
দিয়েছিল। সম্রাট তৈমুর গোটা উজবেকিস্তানকে পুনগর্ঠিত করেন। চেঙ্গিজ খানের
ধ্বংসকৃত বহু মসজিদ, মাদরাসা ও বিশিষ্ট স্থাপনা তিনি পুন:নির্মাণ
করেন। বিশেষত সমরকন্দকে তিনি পুনর্গঠিত করে সমৃদ্ধ শহরে পরিণত করেন।
উজবেকিস্তানে তৈমুরের এসব অনন্য অবদানের কারণে
উজবেকিস্তানের লোকেরা তৈমুরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকে। তারা তৈমুরের
নামের আগে আমীর বা উস্তাদ বা শায়খ শব্দ ব্যবহার করে এভাবে বলে- আমীর তৈমুর, উস্তাদ
তৈমুর, শায়খ তৈমুর। তৈমুর লং-এর জীবনে সমালোচনার মতো বহু
কর্মকাণ্ড রয়েছে। তা সত্ত্বেও উজবেকিস্তানের লোকেরা তৈমুরকে একজন ধর্মপরায়ণ ও
নেককার সম্রাট হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। সমরকন্দের একজন আলেম থেকে জানলাম তৈমুর
হাফেজে কুরআন ছিলেন। তৈমুরের মাতা নকশবন্দিয়া সিলসিলায় আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন।
যাহোক প্রকৃতপক্ষে তৈমুরের ব্যাপারে বলা যায়-
وهو من الذين خَلَطُواْ عَمَلًا صَٰلِحًا وَءَاخَرَ سَيِّئًا عَسَى ٱللَّهُ أَن يَتُوبَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ .
তিনি এমন ধরনের লোক যাদের জীবনে ভাল ও মন্দ উভয় রকমের কাজ রয়েছে। আশা করা
যেতে পারে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল অতি দয়ালু।
সম্রাট বাবর
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আসল নাম
জহিরউদ্দিন মুহাম্মাদ। তিনি সম্রাট তৈমুর লং-এর বংশধর। তৈমুর ছিলেন তার প্রপিতামহ।
আবার বাবর জাতিতে ছিলেন উজবেক। আধুনিক উজবেকিস্তানের ফারগানা উপত্যকার আন্দিজানে
১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন
ফারগানা রাজ্যের গভর্ণর। একসময় বাবর সমরকন্দও বিজয় করেছিলেন। এসব বহুবিধ কারণে
এখনও বাবরকে উজবেকিস্তানে একজন বিশেষ জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করা হয়।
উলূগ বেগ
উলূগ বেগ ছিলেন আমীর তৈমুর লং-এর পৌত্র। আমীর তৈমুরের চতুর্থ পুত্র শাহরূখের
জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ছিলেন মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্টাতা জহির উদ্দীন মুহাম্মাদ
বাবরের প্রপিতামহ। উলূগ বেগের মূল নাম মুহাম্মাদ তারেক। উলূগ বেগ হল তার উপাধি, যার
অর্থ মহান শাসক।
উলূগ বেগ সমরকন্দে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী
কালে মির্জা শাহরুখ তার রাজধানী হেরাতে (বর্তমানে আফগানিস্তানে) স্থানান্তরিত করেন
এবং উলূগ বেগ ষোল বছর বয়সে সমরকন্দের মুখ্য প্রশাসক নিযুক্ত হন (১৪০৯) । ১৪১১
সালে তিনি সমগ্র ট্রান্সঅক্সিয়ানা অঞ্চলের অধিপতি হন । ট্রান্সঅক্সিয়ানা (Transoxiana)
হচ্ছে
লাতিন ভাষায় মধ্য এশিয়ার আমুদরিয়া ও সিরদরিয়ার মধ্যবর্তী একটা অঞ্চলের নাম।
এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল আধুনিক উজবেকিস্তানের পূর্বাঞ্চল, তাজিকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণ কাজাখিস্তানের একটা অংশ, তুর্কমেনিস্তানের একটা অংশ এবং দক্ষিণ
কিরঘিজস্তান।
উলূগ বেগ জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গণিতের নানা বিভাগে (যেমন: ত্রিকোণমিতি
[trigonometry] বা গোলকীয় জ্যামিতি [spherical geometry]) অবদানের জন্য বিখ্যাত।
আমীর তৈমুর মিউজিয়ামে যা যা দেখলাম
মিউজিয়ামে ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়ল উছমানী
আমলের হাতে লেখা কুরআন মাজীদ। ইসলামের
তৃতীয় খলীফা হযরত উছমান (রা.)-এর জামানার হাতে লেখা কুরআন মাজীদ।
এরপর দেখলাম উজবেকিস্তানের বিভিন্ন আমলের শাসক ও
রাজা-বাদশাহদের ছবি। যেমন: উলূবেগ মির্জা, আব্দুল্লাহ মির্জা, সুলতান
মির্জা, সুলতান আবূ সাইদ মির্জা, সম্রাট বাবর, সুলতান
আলী মির্জা, সুলতান আহমেদ মির্জা- এরকম আরো অনেক
রাজা-বাদশাহর ছবি।
এরপর দেখলাম আমীর তৈমুরের অসিয়তনামা। তিনি ফার্সী ভাষায় নিজের সন্তান এবং
অধীনস্থদের যেসব অসিয়ত করেছিলেন, সে অসিয়তনামা।
এরপর দেখলাম তৈমুরের সৈন্যদের সে আমলের পোশাক, ঘোড়ার
জিন, সৈন্যদের ঢাল তরবারি, সৈন্যদের বর্ম, শিরস্ত্রাণ
প্রভৃতি। আরও দেখলাম পুরনো আমলের তৈজসপত্র। বিশেষত ব্রঞ্জের তৈজসপত্র ইত্যাদি।
এরপর দেখলাম উজবেকিস্তানের আরেক শাসক মির্জা উলূগ বেগের স্মৃতি চিহ্ন। তার
হস্তলিপি। উলূগ বেগ আমলের গ্রহ-নক্ষত্র দেখার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
এরপর দেখলাম, সম্রাট বাবরের স্মৃতিমূলক কাব্যনামা। যে
কাব্যনামাতে তার দরবারে কবিরা যেসব কবিতা বলত সেগুলো লিপিবদ্ধ রয়েছে।