লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم. نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد:
ইদানিং জাদীদ আরবি তথা আধুনিক আরবী শেখা ও শেখানোর তৎপরতা পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ লক্ষ্যে বহু স্থানে প্রশিক্ষণের আয়োজন হতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হচ্ছে। বিষয়টা অনেতিবাচক নয়। আধুনিক আরবী জানা থাকলে বহুবিধ ফায়দা হয়। তার মধ্যে রয়েছে আধুনিক আরবী পত্র-পত্রিকা ও আধুনিক আরবিতে লিখিত কিতাবপত্র পাঠ করে বুঝার যোগ্যতা অর্জন হয়, আরবী মিডিয়ার নিউজ ও বিবরণগুলো শুনে বুঝার সক্ষমতা লাভ হয়, আরব দেশসমূহে বা আরব দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানসমূহে চাকরী করায় সুবিধা হয়, আরবদের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে সুবিধা হয়, আরব দেশগুলোতে সফর করলে কাজে লাগে ইত্যাদি। আধুনিক আরবী শেখার উপরোক্ত ফায়দাগুলো অনস্বীকার্য। তবে কুরআন হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে, দক্ষ আলেম হওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক আরবির তেমন ভূমিকা নেই বলা চলে। কুরআন হাদীছ ও আরবী মা’খাযে ক্বাদীম থেকে অর্জিত ইলম আধুনিক আরবিতে প্রচারের জন্যও আধুনিক আরবি জানার প্রয়োজন রয়েছে, তবে কুরআন হাদীছ ও আরবী মা’খাযে ক্বাদীম থেকে সেই ইলম অর্জন করার জন্য ক্বাদীম আরবিতে দক্ষতাই অপরিহার্য। কারণ কুরআন হাদীছ ক্বাদীম আরবি ভাষায়। ইসলামী তথ্যভাণ্ডারের অপরিহার্য মা’খাযসমূহ ক্বাদীম আরবী ভাষায়। তাই বিজ্ঞ আলেম হওয়ার জন্য ক্বাদীম আরবী ভাষায় দক্ষতা অপরিহার্য, জাদীদ আরবিতে নয়। কেউ জাদীদ আরবিতে দক্ষ নয়, জাদীদ আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে সক্ষম নয় কিন্তু কাদীম আরবিতে দক্ষ, তাহলে তার পক্ষে বিজ্ঞ আলেম হওয়া সম্ভব। বাস্তবতার দিকে তাকালেও দেখা যাবে প্রচুর সংখ্যক এমন আলেম রয়েছেন যারা জাদীদ আরবিতে পারঙ্গম নন, আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতেও অভ্যস্ত নন, অথচ তারা সর্বজন স্বীকৃত বিজ্ঞ আলেম। অতীতেও এমন বহু আলেম অতিবাহিত হয়েছেন যারা জাদীদ আরবিতে পারঙ্গম না হওয়া সত্ত্বেও দক্ষ আলেম হিসেবেই স্বীকৃত ছিলেন। এর বিপরীত একজন ক্বাদীম আরবিতে দক্ষ নয় তাহলে সে জাদীদ আরবিতে যতই দক্ষ হোক, জাদীদ আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে যতই সক্ষম হোক, তার পক্ষে বিজ্ঞ আলেম হওয়া সম্ভব নয়, যতক্ষণ না সে ক্বাদীম আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে। বস্তুত বিজ্ঞ আলেম হওয়ার জন্য জাদীদ আরবিতে পারঙ্গম হওয়ার বা আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে সক্ষম হওয়ার কোনোই অপরিহার্যতা নেই। জাদীদ আরবির সম্পর্ক আধুনিক আরবী পত্র-পত্রিকা ও আধুনিক আরবী কথাবার্তা বুঝা ও সেভাবে বলা লেখার সাথে, কুরআন হাদীছের ইলমের সাথে নয়। আর আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে পারা একটা অভ্যাস অনুশীলনের ব্যাপার মাত্র। একজন অনভিজ্ঞ আলেম এমনকি একজন গর-আলেম ব্যক্তিও অভ্যাস অনুশীলন করলে আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে পারবেন। পক্ষান্তরে অভ্যাস অনুশীলন না থাকলে একজন বিজ্ঞ আলেমও হয়তো তা পারবেন না। বিজ্ঞ আলেম হওয়ার সাথে আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে পারার কোনো অপরিহার্যতা নেই। আমাদের আকাবির আসলাফ কওমী মাদ্রাসাসমূহের নেসাবে ক্বাদীম আরবিতে দক্ষ হওয়ার জন্য যা যা রাখা দরকার তার প্রতিই জোর রেখেছেন। কারণ কওমী মাদ্রাসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে দক্ষ আলেম তৈরি করা। জাদীদ আরবির প্রচলন অতি সাম্প্রতিক কালের বিষয় নয়, আরও অনেক আগ থেকেই এর প্রচলন হয়েছে। কিন্তু আমাদের আকাবির আসলাফ মূল নেসাবে জাদীদ আরবি শেখার উপকরণ সংযোজনে তৎপর হননি। কারণ কুরআন হাদীছে দক্ষ ব্যক্তিত্ব তৈরি করার যে মূল লক্ষ্য, সে ক্ষেত্রে জাদীদ আরবির তেমন ভূমিকা নেই। রয়ে গেল জাদীদ আরবির প্রয়োজন, তো সে প্রয়োজন অস্বীকার করা হয় না। আধুনিক বিশ্বে কুরআন হাদীছ প্রচারের জন্য ইংরেজি শেখার প্রয়োজনও তো অনস্বীকার্য। তাই বলে কি ইংরেজি শেখার তাবৎ উপকরণ মূল নেসাবে সংযুক্ত করা হবে? যত ভাষা ও যত বিদ্যা শেখার প্রয়োজন সবই কি কওমী মাদ্রাসার নেসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে? আদৌ নয়। কওমী মাদ্রাসার মূল নেসাবে অর্থাৎ ইবতেদায়ী থেকে তাকমীল পর্যন্ত স্তরের নেসাবে শুধু সেগুলোই অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে কুরআন হাদীছে দক্ষ হওয়ার জন্য যেগুলো না হলেই নয়। আর এটাও আমাদের অভিজ্ঞতা যে, এই নেসাবের যথাযথ হক আদায় করতে গেলে এতে অতিরিক্ত কোন ভাষা ও বিদ্যার চাপ সংযোজন করার অবকাশ নেই। এই নেসাবের হক আদায় করতেই তো একজন ছাত্রের পূর্ণ মেধা ও পূর্ণ সময় নিবেদন হওয়া আবশ্যক। অতএব এই মূল নেসাবে অতিরিক্ত কোন ভাষা ও বিদ্যা সংযোজনের চিন্তা মূল উদ্দেশ্য লক্ষ্যকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে দিতে পারে। এখন রয়ে গেল জাদীদ আরবী শেখার প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি, তো সে প্রয়োজন পূরণার্থে মূল নেসাবের বাইরে তাখাসসুস ফিল আদাবিল আরাবির এক দু’ বছরের নেসাব রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে এখানে জাদীদ আরবির প্রতি আরও জোর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আর ইংরেজিতে কথোপকথন ও বয়ান ভাষণের যোগ্যতা সৃষ্টির প্রয়োজনের বিষয়টি, তো সে জন্য তাখাসসুসের জামাতসমূহে উপযোগী বই নেসাববুক্ত করা যেতে পারে, যেমনটা কিছু মাদ্রাসায় ইতিমধ্যে শুরুও হয়েছে। তবে ইবতেদায়ী থেকে তাকমীল পর্যন্ত নেসাবে কুরআন হাদীছের আরবী তথা ক্বাদীম আরবী ও কুরআন হাদীছ বুঝার জন্য অপরিহার্য শাস্ত্রসমূহের উপর জোর প্রদানেই সীমিত থাকা চাই। উপরোক্ত আলোচনার অবতারণা এ কারণে করলাম যে, ইদানিং ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও কিছু লেখক বক্তা আধুনিক আরবী শেখার গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা তাকমীল পর্যন্ত পড়েও আরবিতে বয়ান ভাষণ দিতে পারে না, আধুনিক আরবী পত্র-পত্রিকা বুঝে না ইত্যাদি কথাগুলো এমনভাবে ব্যক্ত করছেন যেন কওমী মাদ্রাসার নেসাবই ব্যর্থ- এমনটা ফুটে উঠছে, ক্বাদীম আরবির প্রতি অনীহা সৃষ্টির অবতারণা হচ্ছে। অথচ ক্বাদীম আরবির প্রতি অনীহা ও নিস্পৃহতা যোগ্য আলেম তৈরির মূল লক্ষ্যকেই ব্যাহত করবে, যা আদৌ কাম্য নয়। ক্বাদীম আরবির প্রতি অনীহা সৃষ্টির এ কথাটা আমি নিছক আশংকা বা কল্পনা থেকে বললাম না, বরং জাদীদ আরবির গুরুত্ব বয়ানে প্রভাবিত কিছু তালিবে ইলমের মধ্যে ক্বাদীম আরবির প্রতি অনীহা ও হীনম্মন্যতা বোধ উদ্বেগের সাথে লক্ষ করার পরই বলতে বাধ্য হলাম। আসলে ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ার এবং এর বাইরেরও কিছু লেখক বক্তা এমন আছেন যে, তাদের কথাবার্তা ইসলামী তৎপরতা ও চিন্তাধারাগুলোকে কোন অনাকাঙ্খিত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে তা হয়তো তারা ভাল করে ঠাহর করতে পারেন না। তাদের প্রতি সবকিছু আরও গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে, ভারসাম্য রক্ষা করে বলার নিবেদন রইল। সারকথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল- জাদীদ আরবির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করুন তবে ক্বাদীম আরবির প্রতি অনীহা সৃষ্টির অবতারণা যেন না হয়। ক্বাদীম আরবিতে দক্ষতা অর্জনের অপরিহার্যতা বোধ যেন নিজ স্থানে বহাল রাখা হয়। এমনভাবে যেন পাগড়ির ফযীলত বয়ান করা না হয় যে, কেউ সতর খুলে পাগড়ি বাঁধতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। وما علينا إلا البلاغ.