লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد:
সাধারণ মানুষ যারা মাসআলা-মাসায়েল জানে না তারা উলামায়ে কেরামের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবে। এটাই কুরআনের নির্দেশ। ইরশাদ হয়েছে,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ. (سورة النحل : ৪৩)
অর্থাৎ, তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। (সূরা নাহল: ৪৩)
এখন রয়ে গেল উলামায়ে কেরাম সাধারণ মানুষের কাছে মাসআলা কীভাবে বলবেন- দলীল বয়ান করা ছাড়া শুধু মূল মাসআলা বলবেন নাকি দলীলসহ বলবেন? আগে উলামায়ে কেরামের কাছে সাধারণ মানুষ কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করলে উলামায়ে কেরাম সাধারণত মূল মাসআলা বলে দিতেন। ব্যাস। অনেক সময় ফিকহ ফতোয়ার কোন কিতাবের হাওয়ালা বা বরাত দিয়ে মাসআলাটি বলে দিতেন। তারা সাধারণ মানুষের সামনে মাসআলার দলীল বলতেন না। অর্থাৎ কুরআন হাদীছের দলীল উল্লেখ করে তার ভিত্তিতে মাসআলাটি প্রমাণিত হয়-এভাবে বলতেন না। কারণ দলীলের অনেক কিছু একাডেমিক জ্ঞান নির্ভর হওয়ায় দলীলের অনেক কিছু বুঝা সাধারণ মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাইরের হতে পারে। আর কারও সামনে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরের কিছু বলতে হাদীছে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হযরত আলী রা. বলেছেন,
حَدِّثُوا النَّاسَ، بما يَعْرِفُونَ إلخ. (رواه البخاري في صحيحه برقم ১২৭)
অর্থ: মানুষের কাছে এমন কথাই বয়ান করো যা তারা বুঝতে সক্ষম হবে। (বোখারী: হাদীছ নং ১২৭) মুসলিম শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা.-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে-
مَا أَنْتَ بِمُحَدِّثٍ قَوْمًا حَدِيثًا لَا تَبْلُغُهُ عُقُولُهُمْ، إِلَّا كَانَ لِبَعْضِهِمْ فِتْنَةً. (رواه مسلم في مقدمة صحيحه)
অর্থাৎ, তুমি কোন সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ধারণ-ক্ষমতার বাইরের কথা বর্ণনা করলে সেটা তাদের কারও কারও জন্য ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এরই ভিত্তিতে অনেক মনীষী সাধারণ মানুষের সামনে মাসআলার দলীল বলতে নিষেধ করেছেন। এরই ভিত্তিতে ফতোয়ার অনেক কিতাবেও মাসআলার কোনো দলীলই উল্লেখ করা হয়নি, বরং ফিকহ ফতোয়ার কিতাবের হাওয়ালা দিয়েই মাসআলা উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই হচ্ছে সাধারণ মানুষের সামনে মাসআলা বলার হাদীছ-নির্দেশিত রীতি, আকাবির আসলাফ অনুসৃত রীতি।
মাসআলা বলার এই পুরাতন তরীকা ছেড়ে ইদানিং সাধারণ মানুষের সামনে সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল দিয়ে মাসআলা বলার ধারা চালু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এমনতর চর্চা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেক ওয়াজ মাহফিল ও সাধারণ জনতার মজলিসেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। এতে বিশেষ ছয় ধরনের খারাবি রয়েছে। যথা:
(এক) প্রথম খারাবি হল- সাধারণ মানুষের কাছে সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল থেকে মাসআলা বলা হলে তাদের মধ্যে সব মাসআলা সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল থেকে বুঝতে চাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হবে। এই প্রবণতা সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক ও বিভ্রান্তিকর। কারণ এই প্রবণতার ফলে কোন মাসআলার দলীল না বুঝে এলে তারা সেই মাসআলা মানবে না, যদিও সেই মাসআলা সহীহ এবং তার দলীলও সহীহ কিন্ত সেই দলীল বুঝার মত একাডেমিক যোগ্যতা তাদের মধ্যে না থাকার ফলে তারা তা বুঝতে সক্ষম হবে না।
এখানে একথা বলা যাবে না যে, অনেক দলীল তো সহজও রয়েছে যা সাধারণ মানুষের পক্ষেও বুঝা সহজ, তার জন্য তেমন কোন একাডেমিক যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন পড়ে না, সেরূপ দলীল উল্লেখ করাতে কী সমস্যা? সমস্যা হল- কোন কোন দলীল সহজ হলেও এবং সেগুলো দ্বারা সমস্যা তৈরি না হলেও দলীল থেকে মাসআলা বলার ধারা চালু হলে তাদের মধ্যে সব মাসআলা সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল থেকে বুঝতে চাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হবে। আর এই প্রবণতা তাদের জন্য খারাপ। এটা কোন কল্পিত কথা নয়, ইদানিং বাস্তবেও সাধারণ অনেক মানুষের মধ্যে এরূপ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেক মাসআলার জটিল জটিল দলীল-আদিল্লাহ নিয়ে তাদের মাথা গরম, দলীলে দলীলে প্যাঁচ লাগিয়ে বসে থাকছে, যেসব জটিলতা নিরসন ও প্যাঁচ ছাড়ানোর যোগ্যতা তাদের নেই। ফলে হল (সমাধান) বুঝে না আসার কারণে তারা মাসআলা মানছে না। অথচ দলীল-আদিল্লাহর প্যাঁচ ছুটিয়ে, দলীল-আদিল্লাহর জটিলতা নিরসন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যোগ্যতাই তাদের নেই। এই প্রবণতা যেন তৈরি হতে না পারে তাই তাদের সামনে মাসায়েলের দলীল বর্ণনা সমূলেই পরিহার করা চাই। আল্লাহ না করুন সাধারণ মানুষের মাঝে সব মাসআলা দলীল দিয়ে বুঝতে চাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক হয়ে গেলে তাদের মাসায়েল বুঝাতে গিয়ে উলামায়ে কেরামকে অনেক বেশি পেরেশানি উঠাতে হবে। তারপরও হয়তো তারা অনেক দলীল বুঝতে সক্ষম না হওয়ায় সঠিক মাসায়েলের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্ধে বা বিভ্রান্তিতে থাকবে।
উল্লেখ্য, যদিও রেওয়ায়েতে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীদের মধ্যে একে অপরকে দলীল দিয়ে মাসআলা বলার বর্ণনাও দেখা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে বহুবিধ কারণে তাদের মধ্যে কুরআন হাদীছের দলীল বুঝার যে যোগ্যতা ছিল তা আমাদের সাধারণ মানুষদের মাঝে অনুপস্থিত। তদুপরি সে যুগে মাসায়েলের কিতাবও এরকম সংকলিত হয়নি। অতএব আমাদের সাধারণ মানুষের অবস্থাকে তাদের অবস্থার উপর এবং সেই যুগের অবস্থার উপর কেয়াস করা ঠিক হবে না। তদুপরি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীদের মধ্যে দলীল উল্লেখ না করে মাসআলা বলার রীতিও ছিল। বর্তমানে আরবদের মধ্যেও দলীল দিয়ে মাসআলা বলার রীতি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেও কথা হল, অনারবদের অবস্থাকে আরবদের অবস্থার উপর কেয়াস করা ঠিক হবে না। তাছাড়া আরবদের মধ্যে এই রীতি থাকার ফলে তারা যে আকাবির আসলাফের ইলমের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে যাচ্ছে এবং ভিন্ন রকম মাসলাক মাশরাবের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা কারও অজানা নয়।
(দুই) দ্বিতীয় খারাবি হল- যিনি দলীল দিচ্ছেন তার হয়তো সেই সংক্রান্ত সব দলীল (সব আয়াত বা সব হাদীছ ইত্যাদি) সেই মূহুর্তে যেহেনে উপস্থিত নেই বা সব দলীল আদৌ তার জানাই নেই। এমতাবস্থায় আয়াত বিশেষ বা হাদীছ বিশেষের ভিত্তিতে গবেষণা করে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে যে মাসআলা বলছেন, তা হচ্ছে আধা অক্ষুরে গবেষণা, ক্ষেত্র বিশেষে ভুল গবেষণা এবং ভুল সিদ্ধান্ত। বস্তুত একটা বিষয়ে যত দলীল রয়েছে সবটা সামনে রেখে সবটার মাঝে সমন্বয় সাধন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে অনেক সময়ই সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না। ফতোয়া বা মাসায়েলের কিতাবে যখন কোন মাসআলা লেখা হয়, তখন সে সংক্রান্ত সব দলীল-আদিল্লাহ সামনে রেখে ধীরে সুস্থে সেভাবেই লেখা হয়, যেমনটা আলোচনার মজলিসে দলীল দিয়ে মাসআলা বলনেওয়ালা নতুন গবেষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
(তিন) তৃতীয় খারাবি হল- অনেক সময় একটা দু’টো দলীলের ভিত্তিতে কোন নতুন মাসআলা পেশ করে দেয়া হয়, পরবর্তীতে আরও দলীল-আদিল্লাহ সামনে আসায় সে মাসআলা ভুল প্রমাণিত হয়। ফলে ঐ দলীল দিয়ে নতুন মাসআলা পেশ করনেওয়ালাকে ইউটার্ন নিয়ে আগের সেই মাসআলার দিকেই ফিরে আসতে হয় যেখানে ফুকাহায়ে কেরামের অবস্থান। এটাকে বলা যায় ভুলের উপর নাকে খত দেয়া। এমনটা অনেকের বেলায় ইদানিং ঘটতেও দেখা যাচ্ছে। এটা বক্তার জন্য অপমান বয়ে আনে। ফতোয়া ও মাসায়েলের নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে মাসআলা বলা হলে এই অপমানের সম্মুখীন হতে হত না।
(চার) চতুর্থ খারাবি হল- দলীল দিয়ে কোন নতুন সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে আর পরে তা অধিকতর তাহকীকের ভিত্তিতে ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তা থেকে রুজূ করা হচ্ছে, তাহলে ইত্যবসরে সাধারণ মানুষ যারা সেই নতুন ভুল সিদ্ধান্তের অনুসরণ করে সঠিক মাসআলা থেকে বিচ্যুত হয়ে বসেছে তার দায় ঐই নতুন গবেষকের ঘাড়ে থেকে যাচ্ছে।
(পাঁচ) পঞ্চম খারাবি হল- দলীল দিয়ে নতুন করে মাসআলা বলা উম্মতের আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও যোগ্য ফুকাহায়ে কেরামের স্বীকৃত গবেষণা থেকে মানুষকে বিমুখ করার একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দাঁড় হবে। আর পূর্বসূরী আহলে হক থেকে মানুষকে বিমুখ করা গোমরাহির পথ মুক্ত করে দেয়। হক ও হক্কানিয়াতের উপর টিকে থাকার সন্দেহমুক্ত পন্থা হল আহলে হক আকাবির আসলাফের ইলমের সাথে যুক্ত থাকা।
(ছয়) ষষ্ঠ খারাবি হল- যারা দলীল দিয়ে মাসআলা বলেন মনের এই খাহেশ থেকে যে, তারাও কম যান না, তারাও ইজতেহাদ করে বলতে সক্ষম, তাহলে কেন অন্যদের ইজতেহাদ নকল করতে যাবেন- এরকম লোকদের মনে রাখা চাই বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে যেন ধরাশায়ী হতে না হয়। তাদের ইজতেহাদও উল্টে দেয়ার লোক থাকতে পারে। তাছাড়া আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ইলমের সাথে নিজেদের ইলমের একটু তুলনাও যেন করে দেখা হয়।
যাহোক এসব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সাধারণ মানুষের সামনে মাসআলা-মাসায়েল বলতে চাইলে সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল থেকে নয় বরং নির্ভরযোগ্য ফিকহ ফতোয়ার কিতাব থেকে বলুন। এখানে কেউ যেন এমন ভুল বুঝে না বসেন যে, ফিকহ ফতোয়ার কিতাব থেকে মাসআলা পেশ করার কথা বলা হচ্ছে, কুরআন হাদীছের দলীল থেকে নয়, তাহলে কি কুরআন হাদীছের দলীলকে উপেক্ষা করে মাসআলা বলার কথা বলা হচ্ছে? আদৌ তা নয়। নির্ভরযোগ্য ফিকহ ফতোয়ার কিতাবে যা বলা হয়েছে তা তো কুরআন হাদীছের দলীল থেকেই বলা হয়েছে। অতএব নির্ভরযোগ্য ফিকহ ফতোয়ার কিতাব থেকে বলা আদৌ কুরআন হাদীছের দলীলকে উপেক্ষা করে বলা নয়। তবে হ্যাঁ যদি নতুন কোন বিষয় হয় যার সমাধান ফিকহ ফতোয়ার কিতাবে এখনও লিপিবদ্ধ আকারে আসেনি, সেক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি এতটুকু বলতে পারেন যে, এই মাসআলা কোন কিতাবে দেখিনি, তবে দলীলের আলোকে মাসআলাটি এমন হবে বলে মনে হয়। দলীল ছাড়া বলবেন না, তবে দলীল উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকবেন।
এ গেল মাসআলা-মাসায়েল বিষয়ক কথায় দলীল পেশ করা প্রসঙ্গে বক্তব্য। মাসআলা-মাসায়েল ব্যতীত অন্য আলোচনায় যেমন ফাযায়েলের আলোচনায়, ওয়াজ-নসীহত ও নীতি-নৈতিকতার আলোচনায়- এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সামনেও কুরআন হাদীছের ভাষ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তাতে ঐসব সমস্যা দেখা দিবে না যেগুলোর কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
সারকথা- সাধারণ মানুষের সামনে মাসআলা বলার ক্ষেত্রে পুরাতন তরীকায় ফিরে আসুন অর্থাৎ, মাসআলা বলুন নির্ভরযোগ্য ফিকহ ফতোয়ার কিতাব থেকে, সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল দিয়ে নয়। (তবে হ্যাঁ বিশেষ কোন প্রয়োজন দেখা দিলে সেটা ব্যতিক্রম। যেমন কেউ একটা হাদীছ নেই বলে চ্যালেঞ্জ করল বা এরকম বিশেষ ক্ষেত্র।)
পুরাতন তরীকার ফায়দা হল-
(১) পুরাতন তরীকা সাধারণ মানুষকে সরাসরি কুরআন হাদীছের দলীল থেকে মাসআলা বুঝতে চাওয়ার গলত প্রবণতা থেকে বাঁচাবে।
(২) পুরাতন তরীকা নতুন নতুন অনেক গবেষককে আধা অক্ষুরে গবেষক হওয়া থেকে বাঁচাবে।
(৩) পুরাতন তরীকা নতুন নতুন অনেক গবেষককে নাকে খত দেয়ার অপমান থেকে বাঁচাবে।
(৪) পুরাতন তরীকা সাধারণ মানুষকে নতুন নতুন গবেষকের অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের অনুসারী হওয়া থেকে বাঁচাবে।
(৫) পুরাতন তরীকা উম্মতের আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও যোগ্য ফুকাহায়ে কেরামের স্বীকৃত গবেষণা হতে বিমুখ হওয়ার এবং বিমুখ করার ভুল থেকে বাঁচাবে।
(৬) পুরাতন তরীকা সকলকে আহলে হক আকাবির আসলাফের ইলমের সাথে যুক্ত করে রাখবে। আর হক ও হক্কানিয়াতের উপর টিকে থাকার সন্দেহমুক্ত পন্থা হল আহলে হক আকাবির আসলাফের ইলমের সাথে যুক্ত থাকা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আহলে হক আকাবির আসলাফের তরীকায় থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!
وما علينا إلا البلاغ