লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
হাদীছের অনেক কিতাব সংকলিত হয়েছে। তার মধ্যে আস-সহীহুল বোখারী তথা বোখারী শরীফ সহীহ হওয়ার বিচারে বিশেষ বৈশিষ্টমণ্ডিত। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বোখারী শরীফের বাইরে অন্য কিতাবে সহীহ হাদীছ নেই। বরং বোখারী শরীফের বাইরেও অন্যান্য হাদীছের কিতাবাদিতে হাজার হাজার সহীহ হাদীছ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ইদানিং দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ শরীয়তের কোন বিষয় উত্থাপিত হলে জিজ্ঞেস করেন এ বিষয়ে বোখারী শরীফে কিছু আছে কি? কোন হাদীছ উল্লেখ করলে জিজ্ঞেস করেন হাদীছটি বোখারী শরীফে আছে কি? তাদের এরূপ জিজ্ঞেস করা থেকে এই ভাব ফুটে ওঠে যে, হাদীছটি বোখারী শরীফে থাকলে গ্রহণ করব, বোখারী শরীফে না থাকলে গ্রহণ করব না। তার মানে তো এই দাঁড়াল যে, বোখারী শরীফ ছাড়া অন্য কিতাবে সহীহ হাদীছ নেই কিংবা অন্য কিতাবে সহীহ হাদীছ থাকলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। নাঊযু বিল্লাহ! এভাবে বোখারী শরীফের বাইরে অন্যান্য হাদীছের কিতাবে থাকা হাজার হাজার সহীহ হাদীছকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে। যেখানে একটা সহীহ হাদীছকে অস্বীকার করাই গোমরাহির জন্য যথেষ্ট, সেখানে হাজার হাজার সহীহ হাদীছকে অস্বীকার করা হলে সেটা কত কঠিন গোমরাহী হয়ে দাঁড়াবে! এই কঠিন গোমরাহির দিকে ধাবিত করার জন্য, অন্য ভাষায় বোখারির বাইরে বিশাল সহীহ হাদীছের ভাণ্ডার থেকে উম্মতকে সরানোর জন্যই কেউ বোখারিতে আছে কি বোখারিতে আছে কি- এই আওয়াজ চালু করে দিয়েছে কি না ভেবে দেখবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কারণ আজ বহু মানুষের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোন হাদীছ বোখারিতে না থাকলে তারা সেটি মানতে উদ্বুদ্ধ হয় না। এরূপ মানসিকতা তাদেরকে গোমরাহির দিকে ধাবিত করছে, বহু সহীহ হাদীছ অস্বীকার করার দিকে ধাবিত করছে।
এ কথা সত্য যে, তুলনামূলকভাবে সহীহ হওয়ার বিচারে বোখারী শরীফের মান উপরে। কিন্তু তার অর্থ আদৌ এ নয় যে, বোখারী শরীফের বাইরে আর সহীহ হাদীছ নেই। বোখারী শরীফের ব্যাপারে বিশেষ ভক্তি থাকা ঠিক আছে। কিন্তু এক কিতাবের প্রতি ভক্তি যেন অন্যান্য কিতাবের প্রতি অভক্তি বা অন্যান্য কিতাবের অস্বীকারের দিকে ধাবিত না করে। বোখারিতে আছে কি বোখারিতে আছে কি- এই সুর যারা চর্চা করেন, তারা যেন বিষয়টা ভেবে দেখেন। সাবধান থাকা চাই ‘বোখারীতে আছে কি’- এই প্রবণতা যেন উম্মতকে হাদীছের বিশাল ভাণ্ডার থেকে সরিয়ে দিতে না পারে।
যদি কেউ বলেন, বোখারিতে আছে কি না- এটা জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্য হল বোখারিতে থাকলে হাদীছটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়, এরূপ উদ্দেশ্য খারাপ হতে যাবে কেন, এটা নিয়ে আশংকার কী আছে? তাহলে তাকে বলব, শুধু হাদীছ সহীহ কি না তা নিশ্চিত হওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে মুসলিম শরীফেও আছে কি না তা কেন জিজ্ঞেস করা হয় না। মুসলিম শরীফে থাকলেও তো সহীহ হওয়ার ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়। আবার শুধু হাদীছ সহীহ কি না তা জানাই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে বোখারিতে আছে কি না এই প্রশ্ন না করে হাদীছটি সহীহ কি না এভাবে প্রশ্ন হতে পারত। বস্তুত বোখারির ব্যাপারে যে একটা এমন ভক্তি অনেকের মধ্যে কাজ করছে যা অন্য হাদীছের কিতাবের ব্যাপারে তাদেরকে নিস্পৃহ করে তুলছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
জানি না বোখারিতে আছে কি বোখারিতে আছে কি- এই সুর কারা তুলেছে। কাদের দ্বারা এই সুর আরও তাল পাচ্ছে। হতে পারে কেউ অসৎ পরিকল্পনা নিয়েই এমনটা করছে। আবার এটাও একেবারে অমূলক নয় যে, আমাদেরই কিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে এমনটা হচ্ছে বা হাওয়া পাচ্ছে। আমরা যে ব্যাপক হারে খতমে বোখারির অনুষ্ঠান করা শুরু করেছি এবং এসব অনুষ্ঠানে বোখারী শরীফের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের পর বোখারী শরীফই সর্বাধিক সহীহ কিতাব হওয়ার কথা সাধারণ মানুষের সামনে বলছি, এতে হয়তো সাধারণ মানুষের কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছে বুঝি বোখারির বাইরে কোন সহীহ হাদীছের কিতাবই নেই। কেউ বলতে পারেন আমরা বলছি বোখারী শরীফ সর্বাধিক সহীহ কিতাব- যার অর্থ এ নয় যে, অন্য সহীহ কিতাবই নেই। অন্য সহীহ কিতাবও আছে তবে বোখারির শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তাহলে আমাদের বক্তব্যে সমস্যা কোথায়? তাদেরকে বলব, সাধারণ মানুষ কয়জন এত সুক্ষ্মভাবে কথা বিশ্লেষণ করে বুঝার ক্ষমতা রাখে? সাধারণ মানুষ তো এতটুকুতেও বিভ্রান্ত হতে পারে যে, বোখারী শরীফের জন্য অনুষ্ঠান হয় অন্য কোন কিতাবের জন্য তো অনুষ্ঠান হয় না। তাহলে অন্য কোন হাদীছের কিতাব গুরুত্বই রাখে না। তাহলে খতমে বোখারির অনুষ্ঠানই সাধারণ মানুষের জন্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণ হচ্ছে কি না ভেবে দেখবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিংবা বলা যায় খতমে বোখারির অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না ভেবে দেখবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
খতমে বোখারির অনুষ্ঠান এমন কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল যে, তা করতেই হবে? আমরা যেভাবে গুরুত্বের সাথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় খতমে বোখারির অনুষ্ঠান করা শুরু করেছি না জানি এক সময় মানুষ এটাকে বিশেষ ফযীলতের অনুষ্ঠান ভেবে বসে এবং পূর্বসূরীদের (অর্থাৎ আমাদের) বরাত দিয়ে এটার উপর অবিচল থাকার নীতি গ্রহণ করে। তাহলে সেটা হবে এক নতুন বিদআত এবং আমরা হব সেই বিদআতের সূচনাকারী। আমরা সেই বিদআতের দায় সম্পূর্ণ এড়াতে পারব না। সম্প্রতি হযরত তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুমও খতমে বোখারির অনুষ্ঠান বিদআত হয়ে দাঁড়ানোর আশংকা ব্যক্ত করে বক্তব্য প্রদান করেছেন। আরও অনেক আলেমও এরূপ আশঙ্কায় ইতিমধ্যে খতমে বোখারির অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকা শুরু করেছেন।
আল্লাহ আমাদেরকে ভরপুর সচেতনতা দান করুন। আমীন!